‘ধায় যেন’ : সংস্কৃতি, ভাষা, ও নারায়ণ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা



কাকে বলে বাংলা কবিতা? বাংলা কবিতা আবহমানকে রেফার করে না। বাংলা কবিতা যোগ রাখে খন্ডিত দেশকালের সঙ্গে। সারা পৃথিবী নয়, কথাপৃথিবীর বিশেষ দেশকালে তার বিহার যদি অনুমতি করেন বলি, বাংলা কবিতা আদতে স্মৃতির কবিতা। স্মৃতি, আর সংস্কৃতি- বাংলা কবিতা স্বেচ্ছায় সীমাবদ্ধ হয়েছেবাংলা কবিতা যে একটা সাংস্কৃতিক ব্যাপার, আপনি সংস্কৃতিকে রাখুন না রাখুন, সে আপনাকে রেখেছে, আপনি নারায়ণ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা পাঠ করে বুঝে যাবেন, ধৃষ্টতা ক্ষমা করবেন, আপনি আমার চেয়ে বেশিই তা বোঝেন। কবি নন সাংস্কৃতিক কর্মী, দক্ষরাজ নন, শিবই তাঁর মালিক, কিন্তু কবিতা যদি কবির অনুভবে খাঁটি হয়, সে তার নিজের সংস্কৃতিতে গিয়ে ঠিক বসে যাবে, যেমন কচি পাতাটি শিলাস্তরে আঁকা থাকবে লক্ষ-কোটি বছর, নয়তো বিফল হবে প্রাকৃতিক নিয়মে ঠিক যেমন ফুলদানিতে রাখা প্লাস্টিকের ফুল
     অবিশ্যি মানুষ যে নকল ফুল বানাতে পারে, সেই ফুল চোখকে ধোঁকা দিতে পারে, কে জানে হয়তো মৌমাছিকেও, এ কি কম কথা! কৃত্রিম ফুলও কি কম কথা গা! এটা লিখতে গিয়েই সত্যজিতের ‘চিড়িয়াখানা’ মনে পড়ে গেল।
     কিন্তু, বোদলেয়ারকে মনে পড়াই উচিত ছিল। আসলে শ্রেয়র বদলে প্রেয়র দিকে ঝোঁকটা চলেই যায়।

আপনি আমার অনেক আগেই হয়তো ‘ধায় যেন’ কাব্যগ্রন্থের এই কবিতাটি পড়েছেন, যেহেতু আমি এই কবিতাটি পড়েছি খুব বেশি হলে দু-বছর আগেই। বইটি তার ঢের আগে প্রকাশিত।
    
শ্মশানী
    
     চতুর্দিক মধুবেষ্টিত
      আমি অসীম প্রান্তরে বসে আছি

      সন্ধ্যা ঘোর
      আঁধার বলল : আমি শ্মশানী !
      বাড়ি যাবা না

এই কবিতাটি কোনো বিহারী, কোনো মধ্যপ্রদেশী, ঝাড়খন্ডী, উত্তরপ্রদেশী, গুজরাতী, তামিল, পাকিস্তানী, আরব, জর্মান, ফ্রেঞ্চ, বা ইতালীয় ব্যক্তি লিখতে পারবেন না সংস্কৃতিতে ও সমষ্টিবোধে আটকাবেন। ‘শ্মশানী’ শব্দটার কোনো অনুবাদ নেই, অনুসৃজণ নেই। একাধিক শব্দে একে বোঝাতে চাইবেন তাঁরা, বা কোনো চালাক দোভাষীর খোঁজে যাবেনসেটা অশিষ্টতা হবে। একটা শব্দের জন্য একাধিক শব্দ নারায়ণ মুখোপাধায়ের পথিবীতে গর্হিত ব্যাপার।
পৃথিবীর কোনো স্থানে কেউ হয়তো আটকাবেন এর অনুভবেযাঁদের সংস্কৃতিতে বালিঢাকা কবরখানা আছে, বরফে ছেয়ে যাওয়া গ্রেভইয়ার্ড আছে, সমাধিফলক ফাটিয়ে দেওয়া বজ্রপাত আছে, তাঁরা বঙ্গীয় পল্লিগ্রামের শ্মশান কাকে বলে, কাছের শ্মশান থেকে দূরের বাড়ি ফেরার মধ্যে যে এক অপরিসীম আছে, সেখানে শব্দ অসহায় হয়ে পড়ে, তা ঠাহর করতে পারবেন না
     এক কথায়, ‘শ্মশানী’ কবিতাটি একবারই লেখা যেতে পারত, লেখা যেতে পারে, এবং এ এক বাংলা কবিতা। ঠিক যেমন এই কবিতাটি

     বউ ৩

     বাড়ি থেকে কত দূরই-বা হবে –
      বড় জোর এক অধ্যায় ওই আষাঢ়কালীর থান।

      সকলেই আছে
      আছে অন্ধকার, আয়ু আর সংসার
      জীবনের অর্ঘ্য রয়েছে
            কচিডাব জবাফুল মায়া।

      মধ্যরাতে পুজো
      অথচ এ প্রথম প্রহরে
      নিজে এসে, হিমস্বরে কালী
            বউকে ডাকিল

এই কবিতার অনুবাদ অসম্ভব মনে করি আমি। ‘থান’, ‘আয়ু’, ‘সকল’, ‘অর্ঘ্য’ ‘কচিডাব’, ‘জবাফুল’, ‘ডাকিল’... এগুলো বাংলা ভাষার শব্দ নয়, একটা সমষ্টি ও সংস্কৃতির শব্দ। সেখানে লোকজীবন আর আর্যসভ্যতা বোঝাপড়া করে নিয়েছে, এবং একটা গন্ডীই চাইছে ‘আষাঢ়কালী’ আপনি আর কোথায় পাবেন পৃথিবীর? ইউং সাহেব কী বলতেন এই শব্দটির সম্পর্কে? আদি মাতৃচেতনা যদি বর্ষাকালে ধ্বনিত হয়... পৃথিবীর আর কোনো ভাষায় ‘ষ’ আর ‘ঢ়’ আছে এবং তারা এমন হেলাভরে পাশাপাশি বসে বলে আমার মনে হয় না। একটা মাসের নাম তার সবটুকু আবহাওয়া ধরে রেখেছে, শুনুন- আষাঢ়। মেঘ ডাকতে বাধ্য। ভাষা বলছি, ভুল করেই, সংস্কৃতি বা সমষ্টিবোধ বলতে চেয়েছিলাম, স্বীকার করছি এবং তাই সংস্কৃত হিন্দি ওড়িয়া বা অসমীয়া ভাষার কাছে ক্ষমা চাওয়ার তাগিদটা বোধ করছি না
     আর, ‘কালী’ নামটি যেমন কবিতার অন্তিমে পুরুষ আর নারীর ভেদ মুছে দিল, সেটাও কি সম্ভব অন্য কোথাও, অন্য কোনোখানে? হ্যাঁ, আমার প্রশ্ন, শেষের ওই ‘কালী’ কি নারী, দেবী? তাহলে ‘ডাকিল’ কেন? ‘ডাকিলেন’ কেন নয়, “ডাকল’ কেন নয়, ‘মা’ কেন নয়? এই কবিতা তো অবিশ্বাসীর নয়! একজন বিশ্বাসী কখনই কালীর আগে ‘মাআআআ’ ছাড়া বলেন কি !
     ‘নিজে’-র দিকে তাকাই...
এক অধ্যায় একটা দূরত্বের মাপ...
ওই কালী যেন এক ঘোরবর্ণ দশাসই মরদ, সর্দার, কপালে সিঁদুর, গায়ে চিক্কন সর্ষের তেল, হাতে লাঠি, চলেছে ডাকাতিতে... তার আগে, একবার... বৌ...
কিন্তু এতই কি সরল! জীবনানন্দর সেই ‘আট বছর আগের একদিন’-এ যেমন অ্যাবসার্ড, এখানে আছে জীবনের সেই স্তরের আভাস যেখান অবধি শ্বাস কুলোয় না। এই কবিতা জীবনানন্দীয় আবহাওয়ার অসারতা ও অগভীরতা প্রতিপাদন করে। 
এ এক অন্তহীন কবিতা। সোনা নয়, রুপা নয়, কাংস্য সংস্কৃতির। একটা কবিতায় একটা জীবনের মাপ।

     নারায়ণ মুখোপাধ্যায় প্রণীত ‘ধায় যেন’ একটি সাংস্কৃতিক কাব্যগ্রন্থ ঠিক যেমন আমরা সংস্কৃতিকে ভাষা হিসেবে ভুল করেই ফেলি, অভিধান আর ইউনিফর্ম ঘুলিয়ে ফেলি।
যাই হোক, খাঁটি বাংলা কবিতাগুলো আন্তর্জাতিকতা থেকে সৌভাগ্যবশত নিজেদের চিরকাল বিবিক্ত করেছে (রবিবাবু নোবেল কী করে পেয়েছিলেন, এই প্রশ্ন নিশ্চয়ই উথলে উঠছে কারো কারো জিভে! ইয়েটস সায়েবকে তাহলে প্ল্যানচেটে ডাকা যাক?) ঠিক যেমন মাটিতে দুধের কাপঠিক যেমন শিমূলপুরের এক পাগলা মানুষ বুঝতেই পারলেন না কবিতা কাকে বলে। বিদেশে বসে একজন দুর্দান্ত কবিতা লিখে চললেন, কিন্তু বাঙালি কবিতা তাঁর লেখাই হল না। ব্যক্তিগত আর সমষ্টিগতর মধ্যে রয়েই গেল দুস্তর ফারাক। বাংলা কবিতায় এ সব বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।
আমরা একজন কবির নাম তো স্মরণ করতেই পারি, তাঁর কবিতায় কোনো আন্তর্জাতিক গুণ নেই, তাঁর কবিতায় একটা সংস্কৃতি তার বিশেষ ও সামান্য বঙ্গীয় স্থান এবং বিশেষ ও সামান্য বঙ্গীয় কাল নিয়ে চিরকেলে হয়ে আছে, ঠিক যেমন আজকের পম্পেঈ শহর, তিনি রমেন্দ্রকুমার আচার্যচৌধুরী। যদি কোনোদিন একটি সংস্কৃতিকে আবার তিলে তিলে গড়ে তুলতে হয় তার পুরনো অবয়বে, যেমন বলছিলেন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, তাহলে রমেন্দ্রকুমারের কবিতা আমাদের ততটাই আত্মিক সম্বল হবে যতটা তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসগুলো শারীরিকভাবে
নারায়ণ মুখোপাধ্যায়ের কবিতাতেও সেই একই গুণ পাই যখন ‘ধায় যেন’ পড়ি। যেন পম্পেঈয়ের পার্শ্ববর্তী একটি বসতি। যদি রমেন্দ্রকুমা্রের মতো কেউ সমকালেই না থাকতেন, নারায়ণের কাজকর্ম আরো আশান, হয়তো একক, এবং অমরত্বের দিক থেকে নিশ্চিত হত। বাংলা কবিতা বলত অমন কন্ঠস্বর পাইওনি আর। সভয়েই বলছি, রমেন্দ্রকুমারের মতো একজন আদ্যোপান্ত বাঙালি কবির উপস্থিতি নারায়ণ মুখোপাধ্যায়ের পক্ষে খুব স্বাস্থ্যকর নয়। দুজনে প্রায় একই কক্ষপথে যাচ্ছেন, কিছু বাধা আসতে পারে। বরং মণীন্দ্র গুপ্তর উপস্থিতিতে তাঁর হয়তো খুব একটা যাবে আসবে না মণীন্দ্র গুপ্ত আধ্যাত্মিকতার সেই স্তর থেকে আসেন, যেখানে সংস্কৃতি আর আন্তর্জাতিকতায় বিশেষ কলহ নেই।
‘ধায় যেন’ নামক এই কাব্যগ্রন্থ একটি বাঙালি বই। সেখানে বঙ্গীয় আদিখ্যেতা নেই, আতিশয্য নেই, পয়ারের বা মাত্রাবৃত্তের আড়ালে লুকোনো পরভোজী আন্তর্জাতিকতা নেই। খাঁটি সবুজ সাংস্কৃতিক অনুভব যদি পেতে চাই, রুই-ধুতি-গরদ বা লাউচিংড়ির বাইরে ও ভিতরে, এই শীর্ণ বইটি পড়া যেতে পারে।
যেমন ধরা যাক এই কবিতাটি-

রোহিনী

গোবিন্দলাল যাকে হত্যা করেছিল
সে রোহিনী নয়।
ওই দেখ-
অ্যাডভোকেট-রোহিনী! নূপুর পরেছেন।

হাইকোর্টে যাচ্ছেন আকাশবাণীর সামনের পথ দিয়ে
তাঁর মামলা আছে মৃত্যুর বিপক্ষে।
কিন্তু খিদে পেয়েছে- অনর্থকশ্রী।

এত খিদে নিয়ে জটিল মামলায় কি সওয়াল করা যায়।
ফুটপাতে ডাঁসা-পেয়ারা বেচছেন ভগবান।

এই কবিতাটিতে আমরা দেখতে পাচ্ছি, মিথ কীভাবে রচিত হয় এবং সঞ্চিত হয়। বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আবহাওয়ায় যিনি নিজেকে লালন করেননি, যিনি রেলিশ করেননি বঙ্কিমের পরকীয়া ও প্রেমের নারীদের, এই কবিতা তাঁদের জন্য নয়। কোনোরকম উপাসনাপদ্ধতি ছাড়াই এখানে বাংলা উপন্যাস ও বাঙালি কবিতার ভেদ লুপ্ত হয়েছে। রোহিনীর ক্ষেত্রে মানবী আর দেবীর ভেদ লুপ্ত হয়েছে, সে সমকালীনের বদলে এক চিরকালীন নারী হয়ে উঠেছে, এ সবই ঠিক, কিন্তু একটি বিশেষ লোকসংস্কৃতি ঠিক সেভাবেই উঁকি দিয়ে যায় যেমন আমরা পাই দ্রৌপদী বা গান্ধারী বা কুন্তী-র আর্যসমাজকে বা লক্ষীবাঈ-এর ঝাঁসির ক্ষেত্রে। ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ আর একটা উপন্যাসমাত্র থাকে না। সে যেন হয়ে ওঠে এক নতুন টেস্টামেন্ট।
নারীবাদীরা এই কবিতাকে কীভাবে দেখবেন, কৌতুহল হয়। অবিশ্যি তাঁরা মল্লিকা সেনগুপ্তকে নিয়েই বেশি ভাবেন, নারায়ণ থেকে যান চোখের আড়ালে। অবিশ্যি যারা ভাবেন মাটির পুতুল আর ছৌ নাচের মুখোশে লোকসংস্কৃতি আছে, সাইবার কাফে জিনিসটা লোকসংস্কৃতির বাইরের, তাঁদের উদারতার উপরে অনেকটাই নির্ভর করতে হয় এবং হচ্ছে আমাদের। হাইকোর্ট যে একটা খাঁটি বঙ্গীয় ব্যাপার, ঠিক যেমন ব্রিটিশ সংবিধান ছাড়া ভারতীয় আইনকে ব্যাখ্যা করা যায় না, সে সম্ভবত বলার অর্থ হয় না, যাঁরা সেটা মানেন না তাঁরা চন্ডীমন্ডপের দিকেই তাকিয়ে থাকুন

এটা ঠিক নারায়ণ মুখোপাধ্যায়ের পৃথিবীতে আজ আর আমরা নেই, কিন্তু তাতে আমাদের আরাম হয় না১৯৩৭-এ জন্ম তাঁর, স্বাধীনতার বছরে তিনি সম্পূর্ণ জ্ঞানবান ছিলেন। ব্রিটিশের চলে যাওয়া তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন। তাঁর পৃথিবীটা উপনিবেশ আর উত্তর-উপনিবেশে গড়া হওয়ার কথা। অথচ তাঁর কবিতা বাংলিশ হল না। দেশভাগ, উদ্বাস্তু-সমস্যা, দুর্ভিক্ষ, গান্ধীর নিধন বা সুভাষ চন্দ্র বসু-র প্রত্যাবর্তনের ধারণা তাঁর মধ্যে যেভাবে কাজ করতে পারত, আমাদের মধ্যে করবে না। কিন্তু সমাজ তাঁর কবিতায় বহিরঙ্গে উচ্চকিত নয়, সমাজ তাঁর কবিতায় সমাজ-মাত্রই হয়ে থাকে, ফলে তাঁকে আমাদের অন্য সময়ের বলে মনে হয় না, শুধু কী যেন ফেলে আসার জন্য মনে কেমন করতে থাকেতাঁর মোহনবাগান-ঈস্টবেঙ্গল, কংগ্রেস-যুক্তফ্রন্ট আমাদের নয়, এবং তাতে কিছু যায়-আসে নাতাঁর কুলত্যাগিনীদের সঙ্গে আমাদের ভাব-সাব নেই, কিন্তু তারা আমাদের অপরিচিতা নয় তিনি আমাদেরই লোক। তাঁর শৈশব আর তাঁর যৌবনে নিজেদেরগুলোকে মিলিয়ে ফেলতে লোভ হয়।
এটা অবশ্যই ঠিক, উত্তর-উপনিবেশের বিভ্রম থেকে আশ্চর্য সুদূরে তিনি বেঁধেছেন তাঁর কবিতার ঘর। নারায়ণ মুখোপাধ্যায়ের কবিতায় ভিড় করে আছে বিংশ শতাব্দীর একেবারের গোড়ার দিকে নির্মল হাওয়া যাতে দুটো বিশ্বযুদ্ধ নিঃশ্বাস ফেলেনি। তাঁর কবিতা আধুনিক এবং অধুনান্তিকের বাইরে গিয়ে সেই জায়গা থেকে আসে যেটা সেই চর্যাপদের যুগ থেকে ভারতচন্দ্র-রামনিধি গুপ্ত-রামপ্রসাদ সেন-ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ছুঁয়ে আবহমান। রবীন্দ্রনাথ বা জীবনানন্দের কোনো স্পর্শ দেখি না। একজন রমেন্দ্রকুমার আচার্যচৌধুরীর থেকে তিনি এখানেই অনেক আলাদা। রমেন্দ্রকুমারের কবিতায় ব্যক্তিদীপ্তি অনিবার্য ও নাছোড়বান্দাভাবে হাজিরা দেয়, তার ফলেই তিনি আধুনিকের দিশারী হতে পারেন। নারায়ণ মুখোপাধ্যায় ব্যক্তি আর সমষ্টিকে আলাদা করেন না। তিনি কোনোকিছুরই দিশারী নন, উদাহরণ হতে পারেন, মায়া ছড়িয়ে দিতে পারেন আমাদের অস্থিরতায়আমরা তাঁকে সেভাবেই দেখি যেন একটি গাছের জীবনপ্রক্রিয়া, কবিতা তাঁর হয়ে ওঠে যেমন এই কবিতা-

     প্রণাম

     ক্ষমা কর –
      এই সংসারবেষ্টিত ভূমিকে পারাবার দেখি।
      দেখি একগুচ্ছ বালিকা এর তটে নাচে।
      তাদের চুল দোলে দাঁত কাঁপে পা অনুপ্রাস।

      পা বলে : প্রণাম করো শতবার

      আমার জুঁইগাছটা যে আঘাত
      কঠোর নয় যদিও।
      ওকে স্বসঙ্গে না নিয়ে তো করি নাই কিছু

এই ফেসবুকপরিসরে এমন কবিতা দৃষ্টিগোচর হওয়া কঠিন, অনায়াসে হারিয়ে যায় পলকের আড়ালে। আমরা আজ আসলে উদাহরণ নয়, দৃষ্টান্তের দিকে হন্যে হয়ে আছি। মায়া আর মোহ কদাচিৎ আলাদা করতে চাইছি। আমাদের এই সমাজ আর সেই বাঙালির নেই। হ্যাঁ, সমাজ- যা সংস্কৃতি নয়। সমাজের কোনো আবহমান নেই। সে শুধু এইখান, আর এইমাত্র হয়ে থাকে। আজ, শুধু আজ।
সংস্কৃতি- সে ঠিক শিলাস্তরের মতোই, ধরে রাখে কচি পাতা আর ক্ষুদ্র জীবনের ছাপগুলোকে। ডাইনোসর আর আরশোলা সেখানে সমান মুখর, মহীরুহ আর ফার্ণ সেখানে সমান কথা বলেসেখানে নারায়ণ মুখোপাধ্যায়, আশা করি, নিরুপদ্রবে তাঁর সর্বস্ব গচ্ছিত রাখতে পেরেছেন।

এই কবির রেখে যাওয়া ‘ধায় যেন’ পড়তে পড়তে যখন এত আনন্দ হল, এত ভাবনা জাগছে, তাঁকে বরং একটা প্রণাম করি এই লেখার ছলে

3 comments:

  1. 'ধায় যেন' কোথায় পাবো? লেখাটাই শুষলাম।

    ReplyDelete
  2. দারুন কথা লিখেছো বন্ধু .... নারায়ন দাদা'র " ধায় যেন " একটা সংস্কৃতি সম্পন্ন কবিতার চটি বই | এই উপহার আমায় নারায়ন দাদা নিজের হাতে আমায় উনার বাড়ি বেহালায় দিয়েছিলেন | অপূর্ব কবিতা গুলি , কয়েকটা আমি হিন্দিতে অনুবাদ ও করেছি | আমি বলতাম বুঝতে পারছিনা দাদা , উনি বলতেন সব পারবে তুমি .... আজ এখানে সেই কবিতা গুলি ও নারায়ন দাদা কে খুঁটিয়ে লেখা পড়ে তৃপ্তি পেলাম |

    ReplyDelete
  3. আপনার কবিতা বিশ্লেষণ পদ্ধতি অনবদ্য।

    ReplyDelete