গান্ধী অবতার : পুনরাধুনিক অবলোকন




আমাদের স্বাধীনতার পিছনে তাঁর অবদান কী ছিল, আদৌ ছিল কিনা, থাকলে কতটা ছিল, অসহযোগ বা ভারত ছাড়ো-র ভূমিকা আমাদের জাতীয় জীবনে কতটা, উনি আসলে এক সেফটি ভালভ ছিলেন কিনা, এসব নিয়ে ঐতিহাসিকরা ভাবুন। ওই স্বাধীনতা পেতে আমরা যতটা উন্মুখ ছিলাম, ব্রিটিশ শক্তি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কাটিয়ে ওঠার পর এবং আজাদ হিন্দ ফৌজের আপ্রাণ অভিযানের পরে সেটা দিতে ঠিক ততটাই নাচার ছিল কিনা, এসব নিয়েও তাঁরা ভাবুন। সর্বোদয়ের ধারণা আমাদের সমাজে কতটা প্রযোজ্য তা নিয়ে সমাজবিদরা ভাবুন। আমি তাঁকে ব্যক্তি হিসেবে ভাবি, এবং মোহনদাস করমচন্দ গান্ধীকে আমি পুজো করতে পারিনি পারিনা। সেটায় আপনাদের আঁতকে ওঠার কোনোই কারন নেই, আমার উপরে রেগেও যাবেন না আশা করছি। যদি ঠিকভাবে খুঁটিয়ে দেখেন, ওই মানুষটি নিজেই সারাজীবন শুধু নিজের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ গড়ে তোলার জন্যই লড়েছেন, ছুটে বেড়িয়েছেন। নিজের প্রতি ঘৃণা পেরিয়ে, গান্ধী নিজেকে খাঁটি শ্রদ্ধা ও সম্মান করতে চেয়েছিলেন, এই তাঁর জীবনকাহিনি, একটিমাত্র বাক্যে। তাঁর জীবনকাহিনিতে সত্য আর আত্মশ্রদ্ধা ১ হয়ে গেছে।
     গান্ধীর জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন শব্দ হল ‘আমি’তাঁর যে কোনো লেখা পড়লেই বোঝা যায় সেটা। তাঁর যে কোনো লেখাই, আসলে নিজেকে লেখা। তাঁর যে কোনো কাজই, আসলে, নিজেকে করা।
     আমাদের দেশে গান্ধী হলেন সেই মহামানুষ, যিনি নিজের অনেকের মধ্যে নিজের ১-কে সত্যিই খুঁজতে চেয়েছিলেন। সমস্যাটা হয়েছে তখনই, যখন সেই ১-কে তিনি অন্য অনেকের উপরে প্রতাপ দিতে চেয়েছেন। সেই সমস্যাটা নিজের ক্ষেত্রে হয়েছে, নিজের শরীরের ক্ষেত্রে হয়েছে, সম্ভবত পারিবারিকক্ষেত্রে হয়েছে, দেশের ক্ষেত্রে হয়েছে সবচেয়ে বেশি। এই উপমহাদেশকে তিনি বাঁকিয়ে দিয়ে গেছেন। ভারত বেঁকে বসেছে। সেই বাঁক যে মঙ্গলের দিকে, এমন দাবি আমি করতে পারিনা। দেশ আজও সোজা হয়নি, অদূর ভবিষ্যতেও সে বেঁকেই থাকবে গান্ধীর দিকে। গান্ধীই আমাদের দেশে লোকনীতিকে রাজনীতিতে রূপান্তরিত করেছেন। এখানে জনগণের চেয়ে নেতার গুরুত্ব যে আজ এত বেশি, নেতারা যে আজ দেবতার মতো পূজ্য ও ত্রুটিপূর্ন, তার পিছনে আছেন ওই ব্যক্তিটিই। এই যে নেতাপূজা চালু হয়েছে আমাদের দেশে, তার প্রথম বিগ্রহের নাম মোহনদাস করমচন্দ।
সেটাতে যে মঙ্গল হয়েছে, আমি নিশ্চিত নই।
আমরা কেউই কি নিশ্চিত?
     গান্ধী অনেক কিছুর বিরুদ্ধে অকপটে কথা বলেছেন। যা কিছুকেই তিনি অশুভ ভেবেছেন, তার বিরুদ্ধেই কথা বলেছেন। কিন্তু প্রতাপকেন্দ্রের ব্যাপারে তাঁর আপত্তি থাকলেও, প্রতাপের বিরুদ্ধে বলেননি। ঘটনা হল, তাঁর প্রতাপের ধারণা আমাদের কাছে স্পষ্টই হয়না। স্ত্রীজাতির উপরে পুরুষের প্রতাপের বিরুদ্ধে, এমনকি ব্রিটিশ প্রতাপের বিরুদ্ধেও (ব্রিটিশকে তিনি শ্রদ্ধা করতেন। ভালোইবাসতেন।) তাঁর বলা আমার পুরোপুরি বিশ্বাস অর্জন করেনা। তাঁর ১ বলার মধ্যে অনেক বলা বা অন্যরকম বলাগুলো ঠেলাঠেলি করতে থাকে। যা তিনি বলছেন না, সেটাও এসে মাথা গলিয়ে দেয় অনায়াসেই।
অনেক ক্ষেত্রেই মনে হয়, লোকনীতির চর্চা গান্ধী করছেন আত্মপরীক্ষার ছলে। বিরাট আন্দোলনগুলো তাই শেষ অবধি সমষ্টির উদ্দেশ্য চরিতার্থ করেনি। দেশহিতের চেয়ে নিজের নৈতিকতার বোধটির প্রতি তিনি অধিক দায়বদ্ধ। নিজের নৈতিকতার পথে অন্য কারও নৈতিকতা এসে পড়লে, এমনকি সঠিক ও খাঁটি নৈতিকতা এসে পড়লেও গান্ধী যুদ্ধ করবেন, গান্ধী সেই ব্যক্তিকে পছন্দ বা বরদাস্ত করবেন না, সে তিনি রবীন্দ্রনাথ হোন, ভগৎ, বা সুভাষ চন্দ্র বসুএও কি নয় এক প্রতাপবিস্তার?
একটা প্রশ্ন তো ওঠেই, যে গান্ধী অনশনকে প্রায় জীবনের অঙ্গ করে ফেলেছিলেন, ভগৎ সিং-এর মৃত্যুদন্ডের বেলায় তিনি অতদূর নীরব কেন? পশুবলি দেখলে যে তিনি প্রতিবাদে ফেটে পড়েন, একটি মহান প্রাণের বীরবলিতে কি তাঁর চরম আপত্তি নেই! ভগৎ নিজে যখন অনশন করছেন, গান্ধী তো তাঁকে একবার দেখতেও গেলেন না! ভগতের ফাঁসি বন্ধ করতে নয়, মুলতুবি রাখতে উনি অনুরোধ করলেন ভাইসরয়কে। তেজ পাল সপ্রু, জয়কার, আর শ্রীনিবাস শাস্ত্রীকে পাঠালেন ভাইসরয় আরউইনের কাছে। কিন্তু মোহনদাস নিজে আরেকবার আমরণ অনশনে বসলেন না। কেন? গান্ধী-আরউইন চুক্তির একটা ধারাই তো হতে পারত ভগতের মৃত্যুদন্ড রদ। হলনা। পূর্ণ হৃদয়ে চেষ্টা বলা যায়না। কেন? সেটার কারন কি নিজের ভাবমূর্তি এবং পথের পার্থক্য স্পষ্ট রাখা? সুভাষ বা ভগৎ তাঁর পথের লোক ছিলেন না, সে তো শিবাজীও ছিলেন না! আমাদের দেশটা তো কর্ণার্জুনের, আমাদের দেশটা তো তলস্তয়ের নয়! রামচন্দ্রের তো তাহলে উচিত ছিল সদলবলে লংকায় পৌঁছে রাবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নয়, অসহযোগ করা, অথবা বলা... ‘দশানন, জানকীকে ছাড়ো!’ এবং... অবশ্যই নিরস্ত্র অবস্থায়।
গান্ধীর কাঙ্ক্ষিত রামরাজ্য, কোন রামের রাজ্য? কোন রাম?
আসলে ব্রিটিশ আর জাতীয় কংগ্রেসের দাবার ছকে ভগৎ একজন বহিরাগত হয়ে রয়ে গেলেন। একজন ‘পথভোলা যুবক’। সুভাষ চন্দ্রও কি তাই নন? পথের ছেলে তো নেহরু আর সীতারামাইয়া!
     তাঁর আত্মজীবনীতে গান্ধী যখন তাঁর প্রথমবারের শান্তিনিকেতনভ্রমণ সম্পর্কে বললেন, সযত্নে এড়িয়ে গেলেন রবীন্দ্রনাথকে, উল্লেখ করলেন নিয়মরক্ষার মতো। কেন? উনি সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের মধ্যে আরেকজন গোখলে বা মতিলালকে বা ফিরোজশাহ আশা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ওঁর মধ্যে একজন মহাত্মাকে আশা করেছিলেন। দুজনেরই হতাশা অনিবার্য ছিল। রবীন্দ্রনাথ, আমি যতদূর বুঝতে পারি, পরবর্তীকালে বিরক্তির অসংখ্য কারন গান্ধীর মধ্যে পেয়েছেন। ভড়ংসর্বস্বতা তার মধ্যে সবচেয়ে বড়ো, হয়তো। রবীন্দ্রনাথের এক্স-রে মেশিনকে গান্ধী ফাঁকি দিতে পারেননি। আর গান্ধীর জীবনে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন এক মূর্ত অস্বস্তি।
     সত্যিই আমি বুঝতে পারিনা কোন ব্রিটিশকে গান্ধী তাড়াতে চেয়েছিলেন। সত্যিই কি চেয়েছিলেন, অন্তত তাঁর কর্মকান্ডের শুরুর দিকে? আমি এটাও বুঝতে পারিনা কোন ভারতবর্ষকে তিনি স্বাধীন করতে চেয়েছিলেন গান্ধী নিজেই ভারতীয় ছিলেন না পুরোপুরি। তাঁর সময়ের আরো অনেক মনিষীর মতোই তিনি ছিলেন ব্রিটিশ-ভারতীয়। তাঁর নেংটি পরা দেহটি পুরো গুজরাতি হলেও, পূর্ণ ভারতীয় হলেও, আত্মায় একজন অর্ধ-ব্রিটিশই বাস করতেন। প্রথম যৌবন পর্যন্ত উনি পড়াশোনা আর নিজের বিবেক-বিবেচনা-শুদ্ধিকরণ ছাড়া অন্য কোনোকিছু নিয়েই কি ভেবেছিলেন? শ্রবণের পিতৃভক্তির নাটক, বা হরিশচন্দ্রের কাহিনির বাইরে কী পড়েছিলেন? সেই সময় তিনি কি পেয়েছিলেন? পরেও তাঁর পেশাগত এবং লোকনৈতিক ব্যস্ততা কি তাঁকে সেই সুযোগ দিয়েছিল? ভারতীয় সমাজ, পরম্পরা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি এমনকি শিল্পসাহিত্যকে গান্ধী তাই নান্দনিক নয়, এক বিষেষ ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করতে সচেষ্ট ছিলেন। পারিবারিকভাবে উত্তরাধিকারসূত্রে তিনি এক আচারসর্বস্ব হিন্দুধর্মের অধিকারী ছিলেন, সেটাকেই উনি ওঁর ভারতীয়ত্বের অধিকার বানিয়ে নিয়েছিলেন।
            এরই ফল হিসেবে ওঁর লোকনীতিচর্চাতেও লেগেছে আচারের বাহুল্য। চরকা কাটা একটা মস্ত উদাহরণ। এবং আমাদের আচারসর্বস্ব লোকসমাজ সেটাকে লুফে নিল, কারন গান্ধী তাদের সেটাই দিলেন যেটা তারা চায়। ভারতীয়রা তাদের পারিবারিক ডিএনএ থেকে তাঁকে অনুসরণ করল। চরকা কাটার ব্যাপারটা শনি-মঙ্গলবারের নিরামিষ খাওয়ার মতো পালনীয় হতে দেরি করল না। সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’ বা রাজা রাও-এর ‘KANTHAPURA’ উপন্যাসদুটি এখানে যে কোনো রাজনৈতিক দলিল বা ইস্তাহারের চেয়ে বেশি ডকুমেন্টেশন করেছে। ও-দুটো পড়লেই তৎকালীন সাধারণ সমাজে গান্ধীধর্মের প্রভাব বোঝা যাবে।
     হ্যাঁ, গান্ধীধর্ম। ঠিক যেমন বৌদ্ধধর্ম। হাজারখানেক বছর আগে জন্মালে মোহনদাসকে নিঃসন্দেহে হিন্দুরা অবতার হিসেবে বরণ করে নিত। একজন নাথুরাম গডসে সেই ব্যাধের ভূমিকায় থাকতেন যিনি শ্রীকৃষ্ণের চরণকমলে তির বিঁধিয়েছিলেন, বা সেই ভক্ত চুন্দ কাম্মারপুত্তা যে কিনা বুদ্ধকে শূকরের মাংস পরিবেষণ করেছিল এবং তাঁর প্রাণবিয়োগের কারন হয়েছিলবিংশ শতাব্দী তাঁকে দশম (বা একাদশ) অবতার হতে দিলো না। কিন্তু, গান্ধীকে সত্যিই আমি জননেতার বদলে একজন অবতারের ভূমিকায় অবতীর্ণ দেখতে পাই। ঠিক যেমন যেশাস তাঁর সময়ে একজন ধর্মগুরুর চেয়ে জননেতাই ছিলেন, তিনি বিপজ্জনক ছিলেন বলেই তাঁকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়।  ভারতীয়রা ঠিক এমন নেতাকেই চায়, এবং সেটা আমরা এই ২০১৫ সালে বসেই হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। আজ বুঝতে পারছি সিনেমার নায়কের চেয়ে একজন লোকনেতাকে আমাদের দেশে অনেক বেশি মোহময় ও বিনোদনমূলক হতে হয়। এই ব্যবস্থা গান্ধী-পরবর্তী পরিসরে চালু হয়েছে। আজ তো সিনেমার নায়করাই পার্লামেন্টে বসার সবচেয়ে হকদার হয়ে উঠছেন।
     লোকনীতিতে ধর্মের এবং জাতপাতের কৌশল যে আজ মাথা চাড়া দিয়েছে এতটা, এই যে আজকের নেতারা ইফতার পার্টিতে যোগ দিয়ে আর নমাজ পড়ে মুসলিম ভোটব্যাংককে ব্ল্যাকমেল করেন, এটার সূচনা কোথায়? কেন আজও আর্থিক ক্ষমতার বদলে জাতের ভিত্তিতে নিয়োগ হয়, ভর্তি হয়? আমরা ভাবতেই পারি, তাই না? কেন এই বিষবৃক্ষকে বাড়তে দেওয়া হয়েছিল, কেন শুরুতেই তার মূল উচ্ছেদ করা হয়নি?
     গান্ধী পারতেন। উনিই পারতেন। হিন্দু-মুসলিমের ভেদটাকেই উনি অস্বীকার করতে পারতেন, করেননি। ‘হরিজন’ শব্দটাই চরম আপত্তিকর ও অবমাননাকর। অখন্ড ভারতীয় উপমহাদেশের উপরে অতখানি প্রতাপ আর কেউ জীবদ্দশায় পাননি। সমুদ্রগুপ্ত পাননি। কোনো সুলতান বা মুঘল বাদশাহও পাননি। বুদ্ধদেব বা শ্রীচৈতন্য সেটা পেলে ভারতের ইতিহাস অন্য হত। কিন্তু উনি বুদ্ধ বা শ্রীচৈতন্য ছিলেন না। উনি রবীন্দ্রনাথ ছিলেন না।
     গান্ধীর যৌনতার ব্যাপারটা নিয়ে আমার সবিশেষ আপত্তি আছে। আমি নিজে কোনোদিন ব্রহ্মচর্য পালন করিনি, কিন্তু কামের ব্যাপারে সংযম অভ্যাস করেছি। নারীলোলুপতার সঙ্গে একটা জীবনভ’র সংগ্রাম আমার নিজের আছে। সে হয়তো অনেকেরই আছে। গান্ধীকে আমি নিজের সঙ্গে মেলাতে পারিনা। আমি উলঙ্গ রমণীদের এড়িয়ে যাই, তাকাই না তাঁদের দিকে। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে শুয়ে বা বসে নিজের চিত্তকে পরীক্ষা করা একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার। আমার মনে হয় গান্ধী নিজের কামপ্রবণতাকে ঘৃণামিশ্রিত ভয় করতেন। মৈথুন আর আমিষ ভক্ষণ তাঁর কাছে একই ব্যাপার ছিল। আমিষ খাওয়ার বিষয়টিকে নিয়ে গান্ধী তাঁর জীবনে ব্রিটিশবিরোধীতার চেয়ে কম সময় দেননি। উনি দুধ খাবেন কিনা, এই ভাবনা উনি ব্রিটিশের কোনো বিশেষ আইন সমর্থণ করবেন কিনা, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ন ছিল। আর কামের ব্যাপারটায়, যদি অনুমতি করেন, আমি স্বভাবকে হত্যার ছায়া দেখতে পাই। কাম যায় কিনা পরের কথা, হিংসা আসেই। আত্মনিগ্রহের হিংসা। নারীজাতির যৌনাঙ্গকে অশ্রদ্ধার হিংসা।
কাম আমাদের প্রধান রিপু। কিন্তু সে-ই আমাদের চালিকাশক্তি। ছটা রিপু আমাদের জীবনরথের ছ’টা ঘোড়া। শুধু তাদের লাগাম যেন না আমরা নিজের হাত থেকে ফসকে যেতে দিই, যে ঘোড়া বেয়াড়াপনা করবে তাকে শায়েস্তা করতে যেন সমস্যা না হয়। কেউ চাইলে একটা ঘোড়াকে বাদ দিতেই পারেন। কিন্তু সেটা তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার। গান্ধী তাঁর কামপ্রবণতাকে ব্যক্তিগত নয়, জনসমক্ষে তুলে আনলেন। তাঁর দাম্পত্যশয্যাও বাদ গেলনা। এ ব্যাপারে তিনি কস্তুরবার অনুমতি নিয়েছিলেন কি? নিজের কামদমন পরীক্ষা করতে তিনি কন্যাসমা নগ্নিকাদের সঙ্গে শুতেন, কিন্তু সেই নগ্নিকাদের কী হবে? তাঁর নাহয় যৌন উত্তেজনা জাগল না, তাদের কারো যদি কোনোদিন জাগত?
উনি মাসিককে নারীত্বের অপমান মনে করতেন। আরো বলি, আমার মতে উনি নারীত্বকে মানুষের মর্যাদা মনে করতেন না। যোনির প্রতি, স্তনের প্রতি ওঁর কোনো শ্রদ্ধাবোধ ছিলনা। একজন বাতিকগ্রস্ত তরুণ যদি আজ পর্নোগ্রাফি চালিয়ে বসে লক্ষ্য রাখেন তাঁর যৌনাঙ্গ উত্তেজিত হচ্ছে কিনা, প্রিকাম ঝরছে কিনা, উত্থিত ও সিক্ত না হলে তিনি যদি গর্বিত হন, আমার মতে সেই তরুণ ওই পর্নের নায়িকাকে আরো অপমানিতই করেন, বরং হস্তমৈথুন করলে পর্দার মেয়েটি সম্মানিতা হতেন। XXX পর্নের সামনে সংযম অভ্যাস করার চেয়ে হস্তমৈথুন করাই স্বাভাবিক ও স্বাস্থ্যকর, তবে সবচেয়ে ভালো ও ন্যায়সঙ্গত হল পর্ন না দেখা। জীবনে লিবিডো অক্ষুন্ন থেকেও পর্নোগ্রাফির প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়াই একজনের নৈতিকতার সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ। একটি মেয়েকে নগ্ন করে তাঁকে ব্যবহার (রমণ কিন্তু নয়) করা মানেই হিংসা। তাঁকে মৈথুন করা হিংসা, তাঁকে মৈথুন না করা হয়তো আরো বড়ো হিংসা। এ ব্যাপারে দেহতত্ত্বের লোকেরা কী বললেন? পেনিট্রেশন ছাড়া তো ওই সাধনাও মনে হয় সার্থকতায় পৌঁছয় না। এবং ওখানে মেয়েটির স্বাধীনতা ও মর্যাদা পুরুষের চেয়ে বেশি বৈ কম নয়। তাঁরও ঈড়া আছে, পিঙ্গলা আছে, সুষুম্না আছে। মেয়েটিকেও বিন্দুধারণ করতে হয়, জল না খসিয়েই অরগ্যাজম পেতে হয়।
আমার মনে হয়না নারীত্বের প্রতি গান্ধীর মানসিকতা অহিংস ছিল। পুরুষের প্রতাপের ধারণা তাঁর মন থেকে কোনোদিনই মুছে যায়নি, যতই বৃদ্ধ তিনি আভা বা মনুবেনের ‘মা’ হিসেবে নিজেকে পেশ করুন। এটা সত্যিই মনে হয়, গান্ধীর মধ্যে একজন নারী ছিলেন। ওঁর নিজস্ব নারীত্বই ওঁকে সকলের প্রিয় করেছিল, নেতা হিসেবে ও সংগঠক হিসেবে ওঁর ভূমিকা পিতৃসুলভ নয়, বরং একজন মায়ের মতো। অসহযোগ বা ভারত ছাড়ো-র মতো ব্যাপক ও অস্ত্রহীন আন্দোলন একমাত্র একজন নারীই গড়ে তুলতে পারতেন। যে মনুবেন ওঁর সঙ্গে সানন্দে স্বেচ্ছায় সাগ্রহে নগ্ন হয়ে শুতেন, ওঁর তথাকথিত ব্রহ্মচর্যের পরীক্ষায়, তিনিই লিখেছিলেন, ‘Bapu is a mother to me. He is initiating me to a higher human plane through the Brahmacharya experiments, part of his Mahayagna of character-building. Any loose talk about the experiment is most condemnable.
আমি কোনো আলগা কথা বলার স্পর্ধাও রাখিনা একজন মহাত্মার প্রতি, কিন্তু উনি ওঁর নিজের মধ্যে বাস করা মেয়েটিকে খোঁজেননি কোনোদিন। মেয়েদের কামকে উনি স্বীকারই করেননি। যৌন পরীক্ষাগুলোর সময়ে শুধু নিজের শরীরের উত্তেজনাহীনতাতেই উনি আশ্বস্ত ও তৃপ্ত, কিন্তু গিনিপিগ মেয়েগুলোর হরমোন, প্রক্ষোভ, বিকার ও মনঃস্তাত্বিক ফলাফলটার প্রতি উনি ছিলেন বেদনাদায়কভাবে অন্ধ। এটা আমার অভিযোগ। এই মনুবেন সম্পর্কেই ১৯৫৫ সালে মোরারজি দেশাই পন্ডিত নেহরুকে লিখছেন, ‘Manu's problem is more psychological than physiological. She appears to have despaired for life and developed allergy to all kinds of medicines.  
যৌন অবদমনের রীতিই যে ভারতবর্ষের সিংহভাগ অপরাধের কারন, আজও, এই ২০১৫-তেও, তার পিছনে গান্ধীর ভূমিকা আমরা অস্বীকার করতে পারিনা। বর কোনোভাবেই বৌয়ের সঙ্গে একলা হবে না, মনে কামভাব জাগলেই ঠান্ডা জলে স্নান করবে, পুষ্টিকর খাবার থেকে দূরে থাকতে হবে কারন ওগুলোও শরীরকে উত্তেজিত করে। এই কি রামচন্দ্রের চরিত্র ছিল? অযোধ্যাধিপতি রামের মহিষীর সংখ্যা কত ছিল? রাম-সীতার দাম্পত্য সম্পর্কে ওঁর ধারণা কী ছিল? কোন রামচন্দ্রকে উনি চিনতেন, আর কোন রামরাজত্ব উনি চেয়েছিলেন? বাল্মিকীর রামের রাজ্য সেটা অবশ্যই নয়। সম্ভবত তুলসীদাসের। রামায়ণ আর রামচরিতমানসের ভেদ কদাপি মুছে যাওয়ার নয়। এবং গান্ধী রাম আর বুদ্ধের মধ্যেও অনিশ্চয়তা জাগিয়ে তুলেছিলেন। অবিশ্যি বুদ্ধও আত্মনিগ্রহ ও তপশ্চর্যার বিরুদ্ধে ছিলেন। সংযমের কথা বলেছেন, কিন্তু নিজেকে কষ্ট দেওয়া যে পাপ, এও বুদ্ধ বলে গেছেন।
যদি শাস্ত্র দেখা হয়, কলিযুগে তপস্যার কোনো স্থান নেই, তপস্যা নিষিদ্ধ, কারন অহং-এর তৃপ্তি ছাড়া তার অন্য কোনো ফল নেই। বিনয়ী স্বাভাবিকতার চেয়ে বড়ো কোনো ধর্ম কলিযুগে নেই। আর আছে ক্ষমাপ্রার্থনা। আছে সংযম। সংযম আর আত্মনিগ্রহ কিন্তু ১ নয়, ১ হতেই পারে না। আছে ধন্যবাদের ইচ্ছা। বাঁচার কৃতজ্ঞতা।
বাল্মিকীর রামচন্দ্রের খাদ্যাভ্যাস, সীতার সঙ্গে রতিবিলাস, সম্ভবত গান্ধী সেগুলো জানতেন না, জানলেও স্বেচ্ছায় বিস্মৃত হয়েছিলেন। সীতা বনে কেন গিয়েছিলেন? বরের প্রতি পাতিব্রত্যের কর্তব্যের পাশাপাশি বরের প্রতি কামও কি ছিলনা? ১৪টা বছর তাঁকে কাটাতে হত রঘুবীরের সুন্দর সুঠামতম সবুজাভ শরীরটি ছাড়া, এ কি ছিল না পর্যাপ্ত কারন? কাম আর প্রেম যে অভিন্ন, সেখানে হিংসার জায়গা নেই, সেখানে রমণরত ক্রৌঞ্চদম্পতিকে হত্যার পাপ করে নিষাদ, ওই নিষাদ হল প্রথম রাবণ, সেটাকে বাল্মিকী মান্যতা দিলেও, গান্ধী দেবেন না। দশরথ তো বাল্মিকীর লক্ষ্মণের ব্যাখ্যা অনুসারে একজন সেক্স-এডিক্ট ছাড়া কিছুই নন, দশরথ তাঁর কামের মধ্যে হিংসার দুর্যোগ ঘনিয়েছিলেন, এবং লক্ষ্মণ তাঁকে বধ করতে চাইছিলেন! সুগ্রীব যে তাঁর দাদা বালির বিধবা পত্নীকে বিবাহ করলেন, গান্ধী সেটা সম্পর্কে কী বলতেন? রামচন্দ্র, সীতা, শ্রীকৃষ্ণ, রাধা, বৃন্দাবন, শিবলিঙ্গ, গৌরীপিঠ, কামসূত্র, কালিদাস, খাজুরাহো, রাসলীলা, পদাবলী, গীতগোবিন্দম, বাউল, দেহতত্ত্ব, লালন, রবীন্দ্রনাথের দেশকে গান্ধী তাঁর ঈপ্সিত বাঁক দিতে পারেননি, কিন্তু কিছুটা বিগড়ে দিয়েছেন তার স্বাভাবিক অগ্রগতিকে
মেয়েদের প্রতি মনোভাব সুস্থ হল না স্বাধীনতার এত বছর পরেও। আজও ধর্ষনের পরে নেতা-মন্ত্রীরা ধর্ষিতার স্বল্পবাসের দিকে আঙুল তুলতে পারেন, তাঁর চরিত্রের প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করতে পারেন। আজও আমাদের দেশে প্রকাশ্যে মলত্যাগ করা চলে, চুম্বন করা চলে না।
চুমু। কোনো ফুল তার চেয়ে সুন্দর নয়।
ভারতবর্ষে চুমুকে হত্যার দায় গান্ধী কিছুটা হলেও বহন করেন। করছেন। করবেন। গান্ধীগিরি চলছে। চলবে। চলুক। এই জাপানি তেল আর বোল্ড রিলেশনের দেশে, উনি হাসতে থাকুন ১০ থেকে ১০০০ টাকার নোটে।

1 comment:

  1. Quite appropriate a writing at this time of cow-hug day!

    ReplyDelete