অক্টাভিও পাজ এবং মেহিকান মাস্ক



The river that runs by
Is always  
Running back.
Will tomorrow be another day?
          (Last Dawn : অক্টাভিও পাজ)
দীর্ঘ জীবন একজন কবির ক্ষেত্রে আশির্বাদ এবং অভিশাপ, উভয়ই হতে পারে। আমাদের সমকালে দীর্ঘজীবী কবিদের অভিশাপ আমরা দেখেছি, আমরা চেয়েছি তাঁরা এবার নিজেদের জায়গাটা ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়ান, কিন্তু তা আমাদের ভুলিয়ে দিতে পারেনি একজন কবির ১৮৬১ থেকে ১৯৪১ অবধি জীবনপথ। অক্টাভিও পাজ একজন দীর্ঘজীবী কবি। তিনি ১৯১৪- ৩১শে মার্চ থেকে ১৯৯৮-এর ১৯শে এপ্রিল অবধি এই পৃথিবীর জলহাওয়া ভোগ করেছিলেন। ৮৪ বছর বেঁচেছিলেন। এর ফল হিসেবে উইলিয়াম ওয়র্ডসওয়র্থ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বা টি. এস. এলিয়টের সঙ্গে তাঁর একটা সমআসন তৈরি হয়ে যায়, শুধু বাঁচার কারণেই। এতগুলো বছর ধরে অক্টাভিও পাজ সুবিধা পেয়েছিলেন নিজের কবিতাকে গড়ে তোলার, তার অন্তরঙ্গে এবং বহিরঙ্গে বিবিধ পরিবর্তন সাধনের। এ কম কথা নয়। এই সুযোগ পাননি শেলি, কীটস, বদল্যের, এমনকি র‍্যাঁবো। পাননি আমাদের এখানেও অনেকেই। জীবনানন্দ দাশ যদি আরো কুড়িটা বছর বাঁচতেন, সুকান্ত ভট্টাচার্য আরো ত্রিশটা বছর, হয়তো এক-এক ভিন্ন পরিসর রচিত হত। আবার, আমাদের সমকালের কিছু সফল কবি যদি বিগত শতকের ছয়ের বা আটের দশকেই থেমে যেতেন, আজ অবধি নাছোড়বান্দা হয়ে না ছেপে চলতেন, হয়তো তাঁদের নিজেদের পক্ষে এবং সামগ্রিক কবিতার পক্ষেই মঙ্গলজনক হত।
দীর্ঘ জীবনের ফলেই পাজ সুযোগটা পেলেন ছোট-ছোট গীতিকবিতায় শুরু করে দীর্ঘতর সুররিয়াল কাজগুলোর দিকে যাওয়ার, সেখান থেকে আবার পুনরায় কাজ করার সেইসব গদ্য নিয়ে যেগুলোকে কবিতা বলাই চলে না পরম্পরার দিক থেকে। তাঁর শৈলীর বিবর্তণ রীতিমতো আগ্রহোদ্দীপক। প্রকৃত অর্থেই আত্মসচেতন একজন কবি অক্টাভিও পাজ। কবিতা নিয়েই লিখেছেন প্রচুর কবিতা। হয়তো তিনি ভাবতেন কবিতার ব্যাপারে একটা দার্শনিক হেস্তনেস্ত করতে পারলেই বিশ্বচরাচরে মানুষ নিজের স্থানটা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারবে।
এই সব তিনি করতে পেরেছিলেন তাঁর জীবনকালে। অসময়ে বাজেনি ছুটির ঘন্টা।
কবির জীবনকাল এবং অমরত্বের মধ্যে সম্পর্কটা এমনই বিচিত্র।
একজন কবির নাকি চটপট মরে যাওয়া ভাল ! কে বলেন এমন অর্থহীন কথা ! একজন কবিরই চাই এক সুদীর্ঘ জীবন, একজন শিল্পপতির চেয়ে ঢের বেশি করে। কিন্তু ফাটলে ফাটলে ভরা চৈত্রমাসের মাঠের মতো নয়। সবুজ অথবা হলুদ যেন তাঁকে ছেড়ে না যায় কোনো আগামী পরশুর দিকে
এই রঙের কথা বলতেই লাল মনে এল।
অক্টাভিও পাজ তো সেই বিরল মানুষদের একজন যারা বামপন্থার অতিসরলীকৃত রূপটিকে খারিজ করে তাকে গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন, ফলে বাম এবং দক্ষিণ উভয় পক্ষেরই বিরাগভাজন হয়েছিলেন। আমাদের এখানে, পশ্চিমবঙ্গে, আজ সেই অবস্থা। কে যে বামপন্থী, আর কে নন, আজ আমাদের এখানে বোঝা দুষ্কর। বামপন্থা এবং ক্যাথলিক ধর্ম দুটোকেই তিনি প্রশ্ন করতে পেরেছিলেন। ক্যাথলিক বিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবেই তাঁর ধর্মীয় শিক্ষাব্যবস্থাকে মেনে না নেওয়ার সূচনা। পরে তো বিদ্যায়তনকেই মানতে না পেরে মেহিকোর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করলেন কোনো ডিগ্রী না নিয়ে।
অক্টাভিও পাজ একজন ডিপ্লোম্যাট ছিলেন। এমনকি ভারতেও কর্মরত ছিলেন। কিন্তু তাঁর ক্ষেত্রে সম্ভবত শেষ প্রশ্নটা প্রাতিষ্ঠানিক সংহিতা ও অনুশাসন মেনে না নেওয়ার। একজন স্তালিনকে মেনে নিয়ে বামপন্থাকে স্বীকার করা অসম্ভব ছিল তাঁর পক্ষে। অক্টাভিও পাজ একজন দ্রোহী, এবং তাঁর কবিতার সামাজিকতা ও একাকীত্ব তাঁর এই স্বভাবে নিহিত। সেইসঙ্গে আছে বৈপরীত্ব। যুক্তি এবং আবেগ, সমাজ এবং ব্যক্তি... তাঁর কবিতায় সর্বদাই একে অন্যকে প্রশমিত করে।
এবং হ্যাঁ, অক্টাভিও পাজ আদৌ একজন ভদ্র ও বিনীত লেখক নন। লোকটির ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অবস্থানের উল্লেখ আমরা এখানে না করলেও, পাজের যে কোনো লেখা তাঁর দ্রোহ বুঝিয়ে দেয়। পাজের কবিতা এবং গদ্যগুলোও তাঁর ব্যক্তিত্বের মতোই অনুপ্রভ, রাজনীতির গন্ধে ভুরভুর, তীব্র আবেগময়, জটিল, নৈতিক, এবং নিঃসঙ্গ। ইন্দ্রিয়প্রবণতাকে তিনি মিলিয়ে দেন সুররিয়ালের সঙ্গে এক আশ্চর্য গভীরতায়। সেখানে আবার ফিসফাস দেয় অস্তিত্ববাদ, বৌদ্ধধর্ম, হিন্দুধর্ম, আজটেক শিল্প, এমনকি ফরাসি কিউবিজম।
মেহিকো। এই নামের দেশে জন্মেছিলেন অক্টাভিও পাজ। আর বুঝতে চেষ্টা করেছিলেন নিজের স্বদেশবাসীর মানসিক যন্ত্রণাকে যা জন্ম নিয়েছিলে হিংসা আর অতীতচারিতার সঙ্গমে। একজন মেহিকানকে কেউ বুঝতে পারে কি? একজন মেহিকান দুনিয়াকে সন্দেহ করে, কারণ সে নিজেকে বিশ্বাস করতে পারে না, সে তার নিজের জন্মপরিচয় নিয়ে লজ্জিত। The Labyrinth of Solitude-এর একদম প্রথমেই পাজ বলেছিলেন, "The Mexican seems to me to be a person who shuts himself away to protect himself; his face is a mask and (he) is always remote"অক্টাভিও পাজ মেহিকোর কবিদেশটির এই নামের জন্যই আমি তাঁকে মূর্খের মতো ঈর্ষা করি। এই দেশটায় জন্মালে একজন সাদা ল্যাজওয়ালা  বাদামি ঘোড়া ছোটাবেন টকটকে লাল রক্ত শিরায় নিয়ে, অথবা কবিতা লিখবেন, অথবা সেই ছবি আঁকবেন যা ক্যানভাস থেকে লাফিয়ে নেমে আসবে, কিন্তু কোনোটাই করবেন না উদোম হয়ে আত্মসচেতনতার ধারণা ছাড়া একজন মেহিকানকে ব্যাখ্যা করা যায় না। এমন একটা আবহাওয়া আমাকে পেয়ে বসে যখনই অক্টাভিও পাজের কবিতায় মাথা তুলি, বা ফ্রিডা কাহলোর ছবির সামনে নত হই। বুঝতে পারি অনুভূতি আর আড়ালের সম্পর্ক, ব্যথা আর মুখোশের ইয়ারানা
অক্টাভিও পাজ এবং ফ্রিডা কাহলোর এই দেশটাকে মেক্সিকো বলে কেউ যদি ডাকেন, আমার মন খারাপ হয়ে যায়। এ এক নাছোড়বান্দা স্বপ্ন যা যৌন আকাঙ্ক্ষা আর শৈশবের স্মরণশক্তিকে আলাদা রাখে না। পাজ নিজেই যেমন বলেছিলেন Between Going and Coming কবিতায়
The light turns the indifferent wall
Into a ghostly theater of reflections.
নিঃসঙ্গতার গোলকধাঁধায় আমি গোপন অশ্বারোহণ বলতে এটুকুই বুঝি।
আর ভাষার যন্ত্রণা ? ওটা অনুভব না করলে কেউ কবি হয় না। পাজের প্রতিটি শব্দে সেই যন্ত্রণা স্বাক্ষর দিয়েছে। যখন spaces কবিতায় পাজ বলছেন
Space
No center, no above, no below
Ceaselessly devouring and engendering itself
Whirlpool space
And drop into height
Spaces
Clarities steeply cut...
অকস্মাৎ মনে হয় একটা সংকটের ধারাবিবরণী চলছে। শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে। কবিতা কি একটা ধোঁয়া ওঠা তপ্ত লৌহরড... কবি নিজেই তার সুগন্ধের দ্বারা ত্রস্ত, ঠিক যেভাবে আমরা আমাদের বেঁচে থাকার স্তরগুলো সম্পর্কে ভাবতে বাধ্য হলে হই? না। কবি একজন দর্শক, তাঁর দেখার ব্যাপারটা আসলে এক সংগ্রাম। তিনি যা দেখছেন তার কিছুমাত্রও যদি বলে দিতে পারেন, পৃথিবীর সর্বব্যাপী নৈঃশব্দ পরাস্ত হয়। শব্দগুলো ছবি হয়ে বকবক করে, ছবিগুলোকে পাজ বলেছিলেন ‘prophets of my eyesপ্রাচীন গ্রিকরা যেভাবে প্রত্যাদেশে আস্থাশীল ছিলেন, একজন কবি হিসেবে অক্টাভিও পাজ সেই ঐতিহ্যের লোক। পাজের মাধ্যমে আমরা পাই পাজের কবিতা।
নৈঃশব্দের সঙ্গে মৈত্রী করেননি অক্টাভিও পাজ। করা সম্ভবও নয়। আত্মসমর্পণ করে লোকরঞ্জক কবিতা লেখা যায়। আসলে নৈঃশব্দকে আপনি হয়তো পক্ষপাতশূন্য ভাবেন, কিন্তু সে স্বয়ং এই চরাচরের প্রতিনিধি হতে চায়, কবিকে কোনো সাহায্য দেয় না, কোনো প্রবোধবাক্য শোনায় না। একেবারে তাঁর প্রথমের দিকের লিরিকগুলো থেকেই পাজ যুদ্ধ করেছেন নৈঃশব্দের সঙ্গে। The Bird কবিতায় যেমন আমরা পাই
A silence of air, light and sky
In this transparent silence
Day was resting :
The transparency of space
Was silence’s transparency.
এই কয়েকটি লাইন বুঝিয়ে দেয় পাজ তাঁর উচ্চারণের কাছে উপশম আশা করেননি, শুধু চেয়েছেন তাঁর নিজের কন্ঠস্বর তাঁর নশ্বরতাকে স্পর্শ করুক। প্রেমের নীরবতা, নির্জনতার নীরবতা, মৃত্যুর নীরবতা... একটু চুরমার হোক তাঁর গলার আওয়াজে। তাঁর গলাই একমাত্র সেটা পেরেছে তাঁর নিজের ভুবনে।
একের পর এক যে ছবি এবং মোটিফগুলো আমরা অক্টাভিও পাজের কবিতায় পাই, যেমন আলো-অশনি-নারী-স্বচ্ছতা-আয়না-ভাষা-সময়-বৃত্ত-পোড়োজমি... এবং একের পর এক মিথের ধারণা... আমরা বুঝে নিই প্রতিটি শব্দ শুধু অস্ত্র নয়, একেকটি দিব্যাস্ত্র, তারা অক্টাভিও পাজের কথা শুনেছে, কারণ অক্টাভিও তাদের প্রণাম করে এবং ক্ষমা চেয়ে নিয়ে প্রয়োগ করেছেন।
এবং আড়াল। কবির সংকল্পের চিত্ররূপ হল লিখিত শব্দ, লিখিত বাক্য, লিখিত কবিতা। সে স্বয়ং এক প্রাচীর। তার কাজ কবির ইচ্ছাকে আমাদের দৃষ্টির বাইরে রাখা। এর ফলেই পাঠকেরও একটা যুদ্ধ থাকে। একটা তৎপরতা থাকে। পাজ কবিদের মনে করতেন ‘ভাষার অভিভাবক’। কিন্তু ১৯৭৬-এ তিনি লিখেছিলেন
Between what I see and what I say
Between what I say and what I keep silent
Between what I keep silent and what I dream
Between what I dream and what I forget:
Poetry


এই মুখোশটা না থাকলে নৈঃশব্দের সঙ্গে যুদ্ধটা হয় না, রথে ওঠার আগেই রথের চাকা মাটিতে ডুবে যায়।

    

No comments:

Post a Comment