রতন দাসের একটি কবিতা, এবং... শ্রাউড অব তুরিন


প্রিয় কবি রতন দাসের এই কবিতাটি পড়ে নেওয়া যাক। কবিতাটি, আমার মতে, আশা করি পাঠকেরও অমত হবে না, রতন দাসের প্রতিনিধিস্থানীয় একটি লেখা। এই কবিতাটি থেকেই আমি চেষ্টা করব এই কবি সম্পর্কে আমার মনোভাব আপনাদের সামনে মেলে ধরতে। সেটা কি অবিচার হবে? এক বা একাধিক কাব্যগ্রন্থ কি জরুরি? একটিমাত্র কবিতা থেকে একজন কবিকে বোঝা যায় না, বোঝা অসম্ভব, যাঁরা বলেন, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, একটি কবিতা থেকে একজন কবি কি কখনওই সম্পূর্ণ মুক্তি পান ? তাঁর একটি অন্যমনস্ক এবং অবহেলিত এমনকি অন্যের কবিতার স্টাডিসুলভ লেখাও তাঁর যে কোনো সার্থক লেখার মধ্যে উঁকি দেয়, আজীবন তাঁর ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় সঙ্গে থেকেই যায়, এই আমার বিশ্বাস। এখানে সমগ্র সাগর এবং তার একবিন্দু লোনা জলের প্রসঙ্গ না টানলেও চলে।  বরং কবিতাটি পড়ি-


হিম-সন্ত্রাস

কম্বলের ইগলু
হাতের মধ্যে ঢুকে যায় হাত, পেটের মধ্যে পেট
বুকের মধ্যে বুক
শীত ছিঁড়ে ছিঁড়ে টুকরো করি কাগজের মতন
ঠান্ডা হতে হতে শরীর জমে ভ্যানিলা আইসক্রিম ।

হাড়ের ভেতর মরফিন বাঁশি
বাঁশির শব্দে পপ-পরিরা হুইস্কি খেয়ে নেচে ওঠে শিরায়
খুলির ভেতর অন্ধকারের গুঁড়ো ঝরে ...
মনে হয় ঘুমিয়ে পড়ি
মনে হয় জেগে থাকি
অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছিঁড়ে উড়ে যায় বাতাসে
আবার জুড়ে যায়
প্রানপণ চেষ্টা করি হাত-পা টানতে

হে মহাকাল
শুনতে পাচ্ছ তুমি ?
একবার এসে উদ্ধার কর আমাকে
কম্বল-কফিন থেকে টেনে বার কর, প্লিজ
আর পারছি না, মমি হয়ে গেছি !

আমার পরমাত্মা
একবার শেষবার এসে আমাকে জাগাও ...
প্রাণ দাও, তাপ দাও, ক্ষুধা দাও,আলো দাও, যৌনতা দাও
হিম দিয়ো না, শূণ্যতা দিয়ো না, মৃত্যু দিয়ো না ...

     প্রিয় পাঠক, প্রথম লাইনটি লক্ষ্য করুন। মাত্র দুটি শব্দ রয়েছে। একটি বিশেষণ, একটি তার গন্তব্য বিশেষ্য। মাত্র দুটি শব্দে কবি অপরিসীমকে ধরে নিলেন। ইগলু... এস্কিমোদের বরফনির্মিত বাসগৃহ। সে বরফের তৈরি। কিন্তু উত্তাপদানে সক্ষম। মধ্যবিত্ত বাঙালি তাকে পায় কম্বলে। কম্বল... নিরাপত্তার দ্যোতক। আয়েসের অন্য নাম।  যখন সে লোটাকে সঙ্গী পায়, সে হয়ে ওঠে ঘরছাড়ার সম্বল, লোটা যখন নেই, সে ঘরকুণোর আশ্রয়। এখানে মধ্যবিত্ত বাঙ্গালির ঘর আর এস্কিমোর ঘর এক হল। এবং আমরা পেলাম একটি কবিতার সূচণা যা বিশ শতকীয় আধুনিকের বদলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে শুরু হয়ে নব্বইয়ের দশক অবধি বিস্তৃত উত্তর-উপনিবেশ তথা অধুনান্তিককে রেফার করেছে। আমরা আশা করতে পারি এবার পাবো কেওস এবং প্রলাপের উদযাপন।
     দ্বিতীয় এবং তৃতীয় লাইনে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত কবিতার অ্যালুসন রয়েছে। তবে মদ্যপতার মোহে পাঠককে মাতিয়ে দেওয়ার চেষ্টা নেই। আছে বিভ্রমের স্বীকরণ। পা থেকে মাথা পর্যন্ত টলমল করছে বটে, তবে মধ্যরাতের ফুটপাত বদল এখানে নেই। নেই কলকাতা শাসনের স্পর্ধাও। ফলে এই বিভ্রম শুধু মাদকের নয়, যাপনের, এবং এখানেই এই উচ্চারণ শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে মনে করিয়ে দিয়েও তাঁর থেকে অস্ত্যর্থক হয়ে ওঠে।
চতুর্থ লাইনে এসে কবিতাটি পেল এক আশ্চর্য উপমা। উপমা ব্যবহার করলেন... এখানেই দেখুন রতন দাস কেমন তাঁর বন্ধুদের চেয়ে আলাদা হয়ে গেলেন। ধীমান-স্বপন-অলোক-প্রণব-রঞ্জন ... এঁরা কেউ কি এরকম সরাসরি একটা উপমা প্রয়োগ করবেন, করতেন? না। জীবনানন্দ দাশ তাঁদের প্রতিরোধ করতেন। কিন্তু রতন অনায়াসে মিলিয়ে দিতে চাইলেন শীতকাল আর কাগজকে। এল এক অভিপ্রেত ফাঁকা আবহাওয়া। তা জীবনে রাজ করছে। তা যাপনে রাজ করছে। তা চোখের সামনে জুড়ে আছে। তাকে অতিক্রম করতে চাইছেন কবি রতন দাস। ভাস্কর চক্রবর্তী জানতে চেয়েছিলেন শীতকাল কবে আসবে, চেয়েছিলেন শীতঘুম। কিতু রতন চাইলেন সেই শীতকেই খারিজ করতে, নেগেট করতে।
পরের লাইনে যে শরীরের আরেক উপমা পাই, এটাকে অবিশ্যি মেটাফর বলাই ভাল... শরীর এবং ভ্যানিলা আইসক্রিম।  আইসক্রিম লোভনীয়, শরীরও তাই... কিন্তু হিমজমাট সামগ্রী হোক দেহ... কবি চান না। আগের লাইনেই শীতকে চেয়েছেন উড়িয়ে দিতে, এখানে দেখালেন তার কারণ। সেইসঙ্গে এল শরীরের ব্যবহারযোগ্যতা, বিক্রয়যোগ্যতার প্রসঙ্গ, কিন্তু বড়ো বাঁকা সুরে, ইয়ার্কির ভঙ্গিতে।  প্রায় এইভাবেই একজন গুপ্তঘাতক নিজের ছুরিটি নিয়ে, একজন বারবণিতা নিজের যৌনাঙ্গ নিয়ে মজা করতে পারেন, যদি পারেন।
এরপর একটা স্পেসমোট ৩টি স্পেস রতন দাস ব্যবহার করেছেন এই কবিতায়। সেখানে পাঠক একটু স্বস্তি পাচ্ছেন, তারচেয়ে বেশি পাচ্ছেন একটু রোমন্থনের অবকাশ। আগের স্ট্যাঞ্জায় যেটা পেলেন, সেটাকে সঙ্গে নিয়ে নিতে পারছেন স্পেসটিতে এসে। ঠিক এই কারণেই দীর্ঘ সিঁড়িতে কিছু চওড়া ধাপ রাখা হয়।
স্পেসের পরবর্তী লাইনেই এল হাড়ের মধ্যে মরফিন বাঁশির প্রসঙ্গ। হাড়কেও কিন্তু বাঁশি হিসেবে ব্যবহার করা যায়, এবং হয়। কবি কি সে বিষয়ে সচেতন ছিলেন? সম্ভবত না। এখানে কোনো উপমা নেই। রূপক-এর উপস্থাপনও করা হয়নি। হাড়ের মধ্যে মরফিন বাঁশি আসলে আমাদের অন্তর্গত মাদকাসক্তিকেই বোঝায়, বোঝায় মাদকের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিরোধহীনতা। আবার মনে পড়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সেই কবিতা। সেখানে মাদককে গ্লোরিফাই করা হয়েছিল। রতন এই কবিতায় মাদকের সব মায়াজাল ছিঁড়ে ফেলতে চান। বুঝতে পারি দ্বিতীয় এবং তৃতীয় লাইনে শক্তির কবিতার সংযোগ নিছক সমাপতন নয়, কবি খুব ভেবেচিন্তেই ওই দুটি লাইন লিখেছেন।
এরপর এল সেক্স। কিন্তু এই সেক্স ‘প্রাকৃতিক’ নয়। এই সেক্স জীবজগতে শুধু মানুষ নিজের জন্য তৈরি করেছে। সে কি অভিশাপ, না আশীর্বাদ? দেখুন, এল পপপরিরা যারা বাঁশির শব্দে হুইস্কি খেয়ে নাচছে। কোথায় নাচছে? শিরায়। এখানে আবার মনে হচ্ছে রতন কিন্তু শরীরি অনুষঙ্গ ছাড়ছেন না। বারবার ফিরে আসছেন শরীরে। এই কবিতা শারীরিক কবিতা। দৈহিক কবিতাএবং শরীর... ইনোসেন্ট নয়। পাপী নয়। অভিজ্ঞ। ব্লেকের দুটো জগত... সেই যে... ইনোসেন্স আর এক্সপেরিয়েন্স... রতনের এই কবিতা এক্সপেরিয়েন্সের কবিতা।
ষাটের দশকের কোনো বিদেশি ছবিতে... ধরুন ‘ইজি রাইডার’ ... যেমন সাইকেডেলিক ড্রাগস নেওয়ার মত্ততাকে হয়তো একটা কবরখানায় একইসঙ্গে আচ্ছন্ন নগ্নতা এবং ক্যাথলিক ধর্মের মধ্যে ঝুলিয়ে দিয়ে জাম্প কাট এবং নিরীহ লজিকাল ক্র্যাক বা সময়-স্থান নিয়ে চতুর এধার ওধার করে তুলে ধরা হত, এখানে তার একটা আমেজ যেন পাচ্ছি। পুরো দ্বিতীয় স্ট্যাঞ্জাটিই প্রায় এক চলচ্চিত্র। ক্যামেরা যেখানে যেতে পারে না সেখানেই গেছে, এবং, সেটা হয়েছে কারণ রতন দাস ক্যামেরার লোক ছিলেন না, ছিলেন চোখের লোক। ফলে সিনেমাকে পেরিয়ে গেছে কবিতা। আর, সেটা হয়েছে খুব সরলভাবে। সিনেমা কোথাও নেই। আছে নেশার বর্ণনা। এবং, তা বর্ণনাকেও গেছে পেরিয়ে। আপনি যতই কল্পনা করুন, আপনার অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো ছিঁড়ে উড়ে যাচ্ছে বাতাসে, এবং আবার ফিরে এসে জুড়ে যাচ্ছে, এই স্বাদ আপনি পাবেন নাআপনাকে এটা একমাত্র অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে নিতে হবে। রতন কি কোনো অভিজ্ঞতা থেকেই এটা পেলেন? এই নিয়ে সন্দেহ নিশ্চয়তা আলোচনা এবং তর্ক বৃথা। অবিশ্যি, এর মানে এই নয় যে, দ্বিতীয় স্ট্যাঞ্জায় কবিতাটি পুরোপুরি ব্যক্তিগত হয়ে গেল, পাঠকের অধিকার থাকল না। অবশ্যই থাকল। তবে ঠিক ততটাই যতটা ইউরি গ্যাগারিনের মহাকাশবর্ণনায় আপনার-আমার অধিকার রয়েছে। তার বেশি বা কম নয়।
আবার বলছি, আশির দশকের যে স্পর্ধিত কবিরা বাংলা কবিতা নিয়ে হেস্তনেস্ত করতে চেয়েছিলেন, রতন দাস তাঁদের বন্ধু এবং সহযাত্রী হয়েও নিজের জন্য তাঁদের অনেক কিছুই গ্রহণ করেননিসবচেয়ে বড়ো কথা, কবিতার নির্মাণে তিনি সহজতার পথিক ছিলেন, অবশ্যই সরলতার নয়ধীমান চক্রবর্তী বা রঞ্জন মৈত্রর কবিতা পড়তে হলে যে স্তরের পাঠক হতে হয়, যে শ্রম দিতে হয় পুলকের বিনিময়ে, রতন দাসের ক্ষেত্রে দিতে হয় না। কিন্তু আলোচনাটা একইরকম সতর্কতার সঙ্গে করতে হয়। তিনি, সোজা কথা বলেন। সিধে। সরাসরি। এটাকে কি কেউ এন্টিপোয়েট্রি বলবেন? যারা বলতে পছন্দ করবেন, বলার ব্যাপারটা তাঁদের জন্য কঠিন নয়।
এই যে কবিতা থেকে ঘামের সব সম্ভাবনাকে মুছে ফেলা... কিন্তু ঘাম কার? পাঠকের হয়ে রতন দাস সবটুকু ঘাম স্বীকার করছেন। পাঠককে খুব বেশি জ্বালাতন  তিনি করছেন না। এটা রতন দাসের যে কোনো কবিতার ক্ষেত্রেই আমার মনে হয়। এটাই হয়তো কারণ, তাঁকে নিয়ে তাঁর বন্ধুদের চেয়ে কম ভাবা হয়েছে। তাঁর কবিতা নিয়ে তথাকথিত তাত্ত্বিক আলোচনা সম্ভবত একটু কঠিন, কারণ ... ওই যে, সরাসরি কথা বলা। অথচ রতন দাস কোনোভাবেই সুবোধ সরকার নন। নীরেন্দ্রনাথ নন। পাঠককে তিনি ঘাম দেন না, কিন্তু অভ্যাস দেন না, ইচ্ছাপূরণ করেন নাপাঠক ধাক্কা খান। জ্বালাচ্ছেন না বটে, কিন্তু বিরক্ত করছেন। কঠিন ব্যাপার হল, সেটা তিনি করছেন পাঠকের নিজেরই ভাষা নকল করেপাঠকের এই আস্বাদ জাগা স্বাভাবিক যে, রতন দাস খুব অন্যায়ভাবে সেই কথাগুলোই বলছেন যেগুলো তিনি নিজে নিজের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সহসা বলতে চান না। ফলে, রতন পাঠকের প্রিয় কবিও হন না।
রতন দাসের কবিতা সামাজিক কবিতা। সেই সমাজ ব্যক্তির বাইরের নয়। ভিতরের। ভিলেন যদি কেউ বা কারা সেই সমাজে থাকে, তবে পাঠকের নিজের এক বা একাধিক ব্যক্তিত্ব। রতন দাসের কবিতা পাঠককে তাই, সোয়াস্তি দেবে না। তিনিই যে পাঠক! কবি আর পাঠক এক হয়ে গেলেন। এই এক হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা বঙ্গীয় পাঠক অপ্রিয়তায় চায় না।
এই দেশটার নাম যদি বঙ্গদেশ না হত, দুই বাংলা মিলিয়েই বলছি, রতন দাসের নাম আপামর জনতার মুখে মুখে ফিরত। সিধে কথা বলা যদি এন্টি-পোয়েট্রি হয়, কবিতাকে নগ্ননির্জন করে ফেলা যদি প্রতিকবিতা হয়, অনেক ‘জনপ্রিয়’ কবির চেয়ে রতন দাস কাজটা সার্থকভাবে করেছেন। পাঠকের সঙ্গে কথা বলতেই চেয়েছিলেন তিনি। ফর্ম আর কন্টেন্টের যে আবহমান সংঘাত, তাকে তিনি মুছে ফেলতে পেরেছিলেন।
অন্যান্য কবিরা যে অবস্থান থেকে একটি কবিতা শুরু করতে পারেন, রতন চেয়েছেন সেখানেই তাঁর কবিতাকে শেষ করতে। ‘হিম দিয়ো না, শূন্যতা দিয়ো না, মৃত্যু দিয়ো না...’ এটাই কি কবিতার প্রথম লাইন হতে পারত না? কবিতাটি শুরুও হয়েছিল সমাপ্তিতে। ‘কম্বলের ইগলু’... এটা কি এই কবিতার শেষ লাইন হতে পারত না? ফলে, যত সহজে পড়া যায়, তত সহজ নয় এই লেখা। ঝোড়ো বাতাস এবং প্রতিকূল স্রোতের সঙ্গে লড়াই করে একেকটি লাইন কবি অর্জন করছেন। লেখাটাকে বরবাদ করে দেওয়ার ঝুঁকি নিচ্ছেন। সেটা তাঁর উল্লাসের ব্যাপার। কিন্তু, আবার বলছি, শ্রমটা চোখেই পড়ছে না।
রতনের যে কোনো কবিতার মতোই, এই কবিতাটিও আসলে এক ডাটাবেস। নিজের তথ্যগুলো বুকে নিয়ে সে অপেক্ষায় আছে পাঠকের। যেমন একটি নেগেটিভ ফিল্ম অপেক্ষায় থাকে ডেভেলপারের। শ্রাউড অব তুরিন থেকে যেমন যিশুর চেহারা গড়ে দিচ্ছেন আজকের বিজ্ঞানীরা। শ্রাউডটি কি আসল, নাকি ফেক? এই জিজ্ঞাসে কোনজন?
কবিতার শেষ নয়টি লাইন দেখুন, পাঠক, একটি স্পেসও সেখানে আছে। আছে নতুন সূচনার প্রারম্ভ। কবিতাকে ভালোবেসে তাকে কতখানি বস্ত্রমুক্ত করতে হয়, গহনাগুলোকে কেমন খারিজ করতে হয় তার রিক্ত সৌন্দর্যে হাত দিতে... এই লাইনগুলো তার উদাহরণ। এবং দেখুন আকুতি। প্রায় এক শিশুর আর্তনাদ। ‘মহাকাল’-কে সরাসরি ডাকছেন কবি। হাস্যকর শোনাতে পারে, নাটকীয় শোনাতে পারে, এমনকি যাত্রাপালা বা মেলোড্রামার অভিযোগ তুলতে পারেন ‘শীলিত’ পাঠক... তিনি কি জানেন না? কিন্তু আত্মবিশ্বাসটা দেখুন। প্রায় অপরিহার্য করে তুললেন এই হাস্যকর নাটুকে সম্বোধনটিকে। ‘কম্বল-কফিন’... এই অনুপ্রাস একটি জোড়শব্দ। তার মাধ্যমে এল জীবন্মৃতর ধারণা। life in dath নয়, বরং death in lifeঅথবা ... undeadএই তো এক অধুনান্তিক সংবেদনশীল মানবের নির্যাস। অধুনান্তিক... যেখানে কোনো শান্তি নেই, কল্যাণের সম্ভাবনা দূরস্ত।
কোনো বৈদান্তিককে শুধোলে, দার্শনিকভাবে কবির অবস্থান হয়তো এখানে সঠিক নয়। ‘আমার পরমাত্মা’ বলে কিছু হয় কি? পরমাত্মার আগে ‘আমার’ শব্দটি বসতেই পারে কি? কিন্তু দর্শন যেখানে শেষ হয়, কবিতা শুরু হয়। দর্শনের সিদ্ধান্তগুলো কবিতার রাজত্ব অচল পয়সা মাত্র। অসম্ভব আবেগ নিয়ে কবি ডাকলেন ‘তাঁর’ পরমাত্মাকে। বৈদান্তিক ভ্রূ কুঞ্চিত করবেন। কিন্তু কোনো বৈদান্তিক এই কবিতায় ‘শোভানাল্লা’ বলবেন, এমন আশা কি আমরা করছি? করছি না। পরমাত্মা এখানে প্রায় ভগবান হয়ে গেলেন। ঈশ্বর ব্রম্ভ যখন মায়ায় প্রবেশ করেন তিনি ঈশ্বর। তাঁকে আমরা রাজা ভাবতে পারি, যেমন রবীন্দ্রনাথ ভেবেছেন। তাঁকে আমরা সুপারম্যানও ভাবতে পারি। ‘স্যার’... এমন করেও কি ডাকতে পারি না? সেটাই করেছেন রতন দাস। পরমাত্মাকে রতন দাস সেইভাবে স্মরণ করছেন, যেভাবে এক ছাত্র হেডমাস্টারের বেতের সামনে ছোটকাকুকে স্মরণ করে, একজন বন্দী জেলারের ঘরে অসহায়ভাবে নিজের পিতাকে স্মরণ করে, যেভাবে একজন বিপদের মুহূর্তে সিগারেটে টান দিতে থাকে... ফাঁসির আগে আসামী যেমন এক গ্লাস রম চেয়ে নেয়। প্রাণ-তাপ-ক্ষুধা-আলো-যৌনতা ভিক্ষা করছেন কবি। কৃপা নয়, দয়া চাইছেন।
হিম চাইছেন না, শূন্যতা চাইছেন না, মৃত্যু চাইছেন না।
পরমাত্মাকে এই যে আহ্বান, এখানে আমরা পাই একজন বিচ্ছিন্ন মানুষের সামগ্রিকতার অংশ হওয়ার আকুতি। কবি চাইছেন সমগ্র হয়ে উঠতে। পূর্ণ হয়ে উঠতে। কবি চাইছেন বিশ্বপ্রকৃতির অংশ হিসেবে একজন নিজের মানবত্বকে সনাক্ত করুক, চিনুক। তবেই মৃত্যু থেকে সে অব্যাহতি পাবে। আর মৃতদেহ হয়ে থাকতে হবে না। মমি হয়ে থাকতে হবে না।
মহাকাল... কালখন্ড নয়, একটি কালখন্ড মানুষকেও খন্ড খন্ড করে, তাকে করে অভ্যাসের দাস, দৈনন্দিনতার অনুচর। মহাকালকে আহ্বান করে কবি ‘সুসময়’ এবং ‘দুঃসময়’ উভয় থেকেই মুক্তি চাইলেন, খারিজ করে দিলেন উভয় ধারণাকেই।
এখানেই ইতি টানা যায়, তবু বলি, এই কবিতা তার মেজাজমর্জির দিক থেকে আমাকে ব্রিটিশ কবি জেরার্ড ম্যানলি হপকিন্সকে মনে করিয়ে দেয়। এই কবিতাটি...

Thou art indeed just, Lord, if I contend
With thee; but, sir, so what I plead is just.
Why do sinners’ ways prosper? and why must
Disappointment all I endeavour end?
    Wert thou my enemy, O thou my friend,
How wouldst thou worse, I wonder, than thou dost
Defeat, thwart me? Oh, the sots and thralls of lust
Do in spare hours more thrive than I that spend,
Sir, life upon thy cause. See, banks and brakes
Now, leavèd how thick! lacèd they are again
With fretty chervil, look, and fresh wind shakes
Them; birds build – but not I build; no, but strain,
Time’s eunuch, and not breed one work that wakes.
Mine, O thou lord of life, send my roots rain.

     আমি যে প্রভাবের কথা বলছি না, সেটা পাঠক আশা করি বুঝতে পারছেন। এ হল সেই অবশ্যম্ভাবী মিল যা পৃথিবীর দুটি সম্পূর্ণ অনাত্মীয় কবিতাকে কাছাকাছি নিয়ে আসে, এবং দেখানোর মতো কোনো কারণ থাকে না। দুটি কবিতাই অসম্ভব পুরুষালি। কর্কশ। তিক্ত। শিশুসুলভভাবে ঝগড়ুটে। এবং... জ্যামিতিকভাবে করুণ। কান্না কি শুনতে পাচ্ছেন? পাচ্ছেন শুনতে... একজন পুরুষমানুষ রোদন করছেন, বিলাপ নয়, এবং তাঁর টেস্টোস্টেরন এই বিজন অরন্যে অপমানিত হচ্ছে না।
            যদি পৃথিবী আর সায়নাইড ক্যাপসুল আপনার কাছে একই হয়ে দাঁড়ায়, আপাতত, রতন দাসের এই কবিতাটি আপনার প্রিয় হতে পারে, পাঠক। যদি আপনি সত্যিই কাঁদতে চান, প্রতিবেশীকে বিরক্ত না করে অনুচ্চ আর্তনাদ করতে চান, উত্তাপহীনতায় কামশূন্যতায় একঘেয়েমিতে নিঃশব্দ ফেটে পড়তে চান, এই কবিতা আপনার জীবনযাপনসহ সেটা করার ছাড়পত্র দিয়েছে।
     আপনাকে।        
তবে হ্যাঁ, আপনাকে একজন পুরুষ হতে হবে। মধ্যবিত্ত নাগরিক পুরুষ। ডিপ্রেশনের রোগী নন।
বুকে কিছু কড়া লোম থাকলে আরো ভাল।

             

1 comment:

  1. অনুপম, তোমার ব্লগে তোমার কবিতা পড়ে গেছি অনেক বার। আজ হঠাৎ নজরে এলো তোমার প্রিয় কিংবা বলা যায়; তোমার গুরুত্ব পাওয়া কবিতা ও তা নিয়ে ব্যক্তিগত পাঠোদ্ধার। অসামান্য লাগলো রতন দাসের এই কবিতাটি নিয়ে তোমার বলা। তোমার শিল্পবোধ নিয়ে আমার ব্যক্তিগত ধারণা অনেক উঁচুতে। আবারও প্রমাণ হল, গজফিতে দিয়ে মেপে নয় কবিতার এই আলোচনা। একজন অনুপম পারে কবিতার তন্তু ছিঁড়ে তার অনু পরমাণুটুকুকেও দেখাতে।

    ReplyDelete