চ্যাপলিন এক প্রেমপত্র, পৃথিবীর প্রতি





এই ২০১৪-এ স্যার চার্লস স্পেন্সার ‘চার্লি’ চ্যাপলিন আর নিছক একজন অভিনেতা নন। হলিউডি সিনেমার তিনি সর্বোত্তম আধুনিক মানুষ আজ তিনি শুধুমাত্র একজন ভুবনজয়ী চলচ্চিত্র পরিচালকও নন। তাঁর সঙ্গীত, তাঁর আত্মজীবনীমূলক রচনা, তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান এবং আন্তর্জাতিক গুরুত্ব... এদের কোনো একটাকে দিয়েও চ্যাপলিনকে আজ ব্যাখ্যা করা অসম্ভব। এই ২০১৪-এ চার্লি চ্যাপলিন পরিণত হয়েছেন স্বয়ং এক রাষ্ট্রে। তিনি নিজেই তাঁর দেশ, নিজেই তাঁর ব্যবস্থাকিন্তু আমাদের সমসাময়িক দেশ নন। পাসপোর্ট ভিসা লাগবে না। লাগবে দুটো ডানা। যেভাবে আমরা কনস্টান্টিনোপোলের কথা ভাবি, বা আটলান্টিসকে কল্পনা করি, আমার ধারণা, আজ চ্যাপলিনের জীবন এবং কাজ একসাথে মিলে গিয়ে সেটাই হয়ে উঠেছে। তাঁকে পুরোপুরি ধরা প্রায় অসম্ভব ব্যাপারসারা জীবনের সাধনায় এই মানুষটার একটা আন্দাজ মিলতে পারে। হয়তো, তারপরেও বেশ কিছুটা বাকিই থেকে যাবে।
চ্যাপলিন জন্মেছিলেন এক উল্লেখযোগ্য বছরে... ১৮৮৯। বছরটা এমনই যে একটা শতাব্দী ফুরিয়ে আসছিল, আরেকটা শতাব্দী তার জায়গা নেওয়ার জন্য উন্মুখ ছিল। দুটো শতাব্দীর প্রায় সন্ধিস্থলে চ্যাপলিন তাঁর চরম দরিদ্র কিন্তু পরম মায়াময় শৈশব কাটাচ্ছিলেন। অভ্যাসমিশ্রিত দারিদ্রের মধ্যে যে তেতো রোমান্টিকতা থাকে, সেটা তাঁর মজ্জায় মজ্জায় ঢুকে যাচ্ছিল। নিজের ছেলেবেলা নিয়ে চ্যাপলিন একবার মজা করে বলেছিলেন, ‘"I was hardly aware of a crisis because we lived in a continual crisis; and, being a boy, I dismissed our troubles with gracious forgetfulness." এই দারিদ্র্য চ্যাপলিনকে সারা জীবন সঙ্গ দিয়েছে। তাঁর অভিনীত সব চরিত্রই কাঙাল, কেউ অর্থের কেউ প্রেমের। দারিদ্রকে এতখানি সেলিব্রেট করতে চ্যাপলিন ছাড়া আর একজন হয়তো পেরেছেন, তিনি চার্লস ডিকেন্স। ঘটনা হল, আমার মনে হয়, চ্যাপলিন এবং ডিকেন্সের আবহাওয়া কোথাও ওভারল্যাপ করে, একজন ডেভিড কপারফিল্ড যেন চ্যাপলিনের ছায়া হয়ে থেকেছে সারা জীবন, সারা কাজে।
আর উইলিয়াম শেকসপীয়ার? অরসন ওয়েলস বা আকিরা কুরোসাওয়া, বা জাঁ লুক গদারের সঙ্গে শেকসপীয়ারকে সরাসরি যুক্ত করা যায়, চ্যাপলিনকে যায় না। কিন্তু ‘ম্যাকবেথ’-এর পোর্টার সিনে, বা ‘কিং লিয়ার’-এর ভাঁড় হিসেবে আমি অভিনেতা চ্যাপলিনকেই কল্পনা করি, আর কাউকে নয়। আর কেউ হতেই পারেন না। কেন বলুন তো? ওই হাসিতে দাঁত নয়, অশ্রু চিকচিক করে।
আসলে চ্যাপলিন ঊনবিংশ শতাব্দীর আলোর ধারণাকে বুকে নিয়ে প্রবেশ করেছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্ধকারেঊনবিংশ শতাব্দীর দীপ্র লন্ডন শহরকে (তার সব মালিন্যের পরেও, বস্তি-বেশ্যা-জ্যাক দ্য রিপারদের পরেও) বুকে নিয়ে প্রবেশ করেছিলেন বিংশ শতাব্দীর সংশয়াচ্ছন্ন আমেরিকায় (যতই সে এগিয়ে চলুক শক্তি সামর্থ্যের পথে) এর ফলে তিনি হয়ে উঠতে পেরেছিলেন একজন অন্য আধুনিক, বলা যেতে পারে একজন পুনরাধুনিক অভিনেতা। একটা দর্শন নিয়ে তিনি সিনেমায় এসেছিলেন, ফলে সিনেমাকে ছাড়িয়ে যেতে পেরেছিলেন বহুদূর। সিনেমা চেষ্টা করেছে শুধু তাঁর হাত ধরে থাকতে, তাঁর দ্বারা ব্যবহৃত হতে।
প্রাথমিকভাবে সিনেমা চ্যাপলিনকে ব্যবহার করেছে। বিশ্বসিনেমার জনপ্রিয়তার পিছনে চার্লি নামক ‘ট্র্যাম্প’-টির অবদান হয়তো সবচেয়ে বেশি। পশ্চাদ্দেশে লাথি খাওয়া এবং পালটা লাথি কষিয়ে দিতে প্রস্তুত একজন নিঃস্ব ভবঘুরের পিপাসিত জীবনবৃত্তান্ত দর্শককে হাসিয়েছে। সে যত কষ্ট পাচ্ছে, সিনেমাহলে হাসির ফোয়ারা ততই উঠেছে। মহামহিম অ্যারিস্টটল এই ঘটনাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করতেন কে জানে! যদি বাস্টার কীটনের সঙ্গে চার্লির ‘হাসির সিনেমা’-গুলোকে মেলানো হয়, দেখা যাবে চ্যাপলিন হয়তো কোনোদিন নির্মলভাবে হাসাতে চাননি, শুধু আমাদের রসবোধের গোলমালটাকে উসকে দিয়েছেন। গ্রীক কমেডির মতোই তাঁর ছবির মজা আমাদের পারভার্সনের উপরে নির্ভর করে। আমরা আসলে কান্নার বদলে হাসি। এই বৈপরীত্যবোধ তাঁর ছিলসেটাই তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন ‘ট্র্যাম্প’ চরিত্রটিকে সাজানোর জন্য। বলেছিলেন, ‘I wanted everything to be a contradiction: the pants baggy, the coat tight, the hat small and the shoes large ... I added a small moustache, which, I reasoned, would add age without hiding my expression. I had no idea of the character. But the moment I was dressed, the clothes and the makeup made me feel the person he was. I began to know him, and by the time I walked on stage he was fully born.’
একবার জন্মানোর পরে চরিত্রটির আর মৃত্যু হল না। বাস্টার কীটন ছিলেন চার্লির সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী। কীটন নামক অসামান্য অভিনেতা-পরিচালকটি সিনেমার শিল্পটাকে চ্যাপলিনের চেয়েও ঢের ভাল বুঝতেন। কিন্তু চার্লি তাঁকে দমিয়ে রাখতে পেরেছিলেন শুধু আবেগের জোরে। চ্যাপলিনের ছবিতে দর্শক আবেগের যে দোলায় চড়েন, তার সঙ্গে তুলনা হয় না নির্ভার কীটনের, ফলে জনপ্রিয়তার তুলনাটাও আসে না। দুজনে একসঙ্গে কাজও করলেন ‘লাইম লাইট’ (১৯৫২) সিনেমায়, অর্জুণ এবং কর্ণের মতো দুজনেই প্রায় সমান ক্ষমতাশালী সেটা বোঝা গেল, পারস্পরিক শ্রদ্ধাটাও ধরা পড়ল, এবং সেটা ঘটল চ্যাপলিনের নিজেরই পরিচালনায়। আরেক দিকপাল স্ট্যান লরেলের কমিক টাইমিং চ্যাপলিনের চেয়ে অনেক ভাল অনেক ক্ষেত্রেই। কিন্তু তিনিও তুলনায় আসেন না। চার্লি চ্যাপলিন নিঃসন্দেহেই নির্বাক স্ল্যাপস্টিকের সম্রাট। সম্রাটকে যে শ্রেষ্ঠ হতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। এমনকি শ্রেষ্ঠত্বের ধারণাটাকেও তো আমরা সন্দেহ করতেই পারি।
যাই হোক, যেটা নিয়ে কথা হচ্ছিল, চ্যাপলিনের কমিক ধারণা আসলে তাঁর ট্র্যাজেডির ধারণারই মুখোশ পরা রূপ। তিনি নিজেই বলেছিলেন,‘ It is paradoxical that tragedy stimulates the spirit of ridicule ... ridicule, I suppose, is an attitude of defiance; we must laugh in the face of our helplessness against the forces of nature – or go insane.আমাদের হাসিটা আসলে একটা ভাবমোক্ষণ, নাহলে ওই লোকটার কষ্টে আমরা পাগল হয়ে যেতাম। একবার ভেবে দেখা যাক ‘দ্য গোল্ড রাশ’ (১৯২৫) ছবির সেই বিখ্যাত দৃশ্য... সেই জুতো ভক্ষণ করার দৃশ্যটির কথা। জুতোটিকে সেদ্ধ করা হল পরম যত্নে। প্লেটে রাখা হল পরম মমতায়। তাকে যেভাবে পেশ করা হল, এক মহার্ঘ্য টার্কি মোরগেরও সেই সম্মান জোটে না। চার্লির সঙ্গী তার চেয়ে বলবান, সে জুতোর উপরের নরম চামড়াটা নিল, কিন্তু চ্যাপলিন একটি না দমে গিয়ে জুতোর শুকতলা নিয়ে দক্ষহাতে লড়াই শুরু করলেন। পেরেকগুলোকে মনে হল হাড়, সেগুলোকে চুষে নিলেন, যেন তাদের মধ্যেও কিছু সুস্বাদু রস আছে। শেষে একটি তৃপ্তির ঢেকুর তুলতেও ভুললেন না। মুখের ভাব দেখে মনে হল, অতিভোজন হয়ে গেল।
খিদে নিয়ে এই ইয়ার্কি তিনিই মারতে পারেন যিনি খিদেকে চেনেন, এবং তাকে নিয়ে খেলতে জানেন। আর দর্শক যে হাসেন এই দৃশ্যে, সেটা থেকেই প্রশ্ন উঠে আসে... প্রশ্নটা অন্যের ব্যথায় সমান হওয়ার প্রশ্ন। কেন এই দৃশ্য দেখেও আমরা হাসলাম, কাঁদলাম না ? আমাদের কি ত্রস্ত হওয়ার কথা ছিল না এখানে? দুই বুভুক্ষু মানুষ জুতো সেদ্ধ করে খাচ্ছে, সেটাকে আমরা ভয়্যারের মতো দেখছি, মজা নিচ্ছি! হাসতে আমাদের বাধল না! তাহলে তো নরভক্ষণের দৃশ্যেও হাসতে পারি! এবং, হ্যাঁ, সেই ইশারাও চ্যাপলিন ‘দ্য গোল্ড রাশ’-এ দিয়েছেন। সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে হিংস্র ছবিগুলোর একটা এই ‘দ্য গোল্ড রাশ’। আমাদের ত্রাসকে আমরা  হাসির আড়ালে লুকিয়ে ফেলেছি। ঠিক যেভাবে আজ আমরা আধুনিকের ধারণাকে বিনোদনের আড়ালে লুকিয়ে রাখছি। ভুলে থাকতে চাইছি। দায় এড়াতে চাইছি।
সত্যি কথা বলতে কী, চ্যাপলিনের একটি সিনেমাতেও হেসে গড়িয়ে পড়ার সুযোগ নেই, যদি দর্শক সংবেদনশীল হন। একবার ভাবুন ‘সিটি লাইটস’ (১৯৩১) সিনেমার কথা। চার্লি বক্সিং লড়ছেন যেখানে, ভয় পাচ্ছেন, তুকতাক করছেন দস্তানা নিয়ে, রেফারির আড়ালে লুকোচ্ছেন, লুকিয়ে ঘুসি মারার চেষ্টা করছেন, কিন্তু কিছু টাকা তাঁর চাই সেই অন্ধ মেয়েটির জন্য যাকে তিনি ভালবাসেন। শেষ অবধি হেরে গেলেন, ঘুসিটা ঠিকই লাগল, এবং চার্লি সংজ্ঞা হারালেন। এরমধ্যে সিনেমা হলে হাসির ঝড় উঠে গেছে। আমরা একজন অসহায় মানুষের করুণ লড়াইয়ের মজাটা নিয়েছি, প্রাণভরে হেসেছি। ঠিক এইভাবেই হেসেছি ‘দ্য কিড’-এর ( ১৯২১) একাধিক করুণ দৃশ্যে, বা ‘মডার্ন টাইমস’(১৯৩৬)-এর শ্রমিকটির সেই বিদ্রূপে যা আসলে আমাদেরই লক্ষ্য করে, বা ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’-এ (১৯৪০) যখন একজন স্বৈরাচারী পৃথিবী নিয়ে স্বমেহনের মতোই জাগলিং করছেন
একটা সময় আসা অনিবার্য ছিল যখন দর্শক বুঝে ফেলল এই লোকটি আসলে দর্শককে নিয়ে খেলছেন, এমনকি তাকে ঠকাচ্ছেন তার আবেগের জায়গায়। যেখানে তার চোখে জল আসা উচিত, সে নির্লজ্জ বোকার মতো হাসছে। ওই হাসিতে তার অপমান আছে।
শুধু দর্শক নয়, রাষ্ট্রও বুঝে ফেলল এই লোকটি খুব সহজ সরল একজন ভাঁড় নন, এঁর পেটের মধ্যে ঘাতক মতলব লুকিয়ে আছে। যে আমেরিকা তাঁর সামনে হলিউড নামক এল দোরাদোটির দরজা খুলে দিয়েছিল, সেই আমেরিকা তাঁর ‘লাইম লাইট’ (১৯৫২) দেখাতেই দিল না, বরং বাইরের পৃথিবীকে দেখিয়ে ফেরার পথটা বন্ধ করে দিল। ওই সিনেমার বিগতমহিমা জোকারটি আসলে স্বয়ং ষাটোর্দ্ধ চ্যাপলিন। সম্ভবত তাঁর আত্মজৈবনিক পরিসরের একটা বিপুল পরিমাণ আবেগ ওই সিনেমায় খরচ করেছেন লোকটি। এর ফলেই ওটা একটা বিশুদ্ধ সিনেমা হতে না পেরেও চিরকালীন হয়ে উঠেছে। এই সিনেমা বারবার মনে করিয়ে দেয় ঊনবিংশ শতাব্দীর লন্ডনকে। গ্যাস লাইটগুলো মনে করিয়ে দেয়, আবার, চার্লস ডিকেন্সকে। দর্শকদের তিনি আলাদা আলাদা ব্যক্তি হিসেবে চিনতে চেয়েছিলেন। শুধু চেয়েছিলেন হাততালিটা তারা সবাই মিলে দিক। কিন্তু একটা সময় এল যখন তারা তাঁকে দেখে আর হাসতে চাইল না। তিনি বুঝলেন দর্শক আসলে একটা সমষ্টির নাম, এবং সেই সমষ্টি একটি দাণবের মতো তাঁকে নিংড়ে ছিবড়ে করে ছুঁড়ে ফেলে দিতে চাইছে। ছবির নায়ক ক্যালভেরো-র মুখে তিনি বললেন, And about the audience, then I began to fear them … ruthless, unpredictable … like a monster without a head; you never know which way it's going to turn – it can be prodded in any direction … That's why I had to take a drink before I could face them.’ এই ত্রাস সম্ভবত তাঁর প্রাপ্য ছিল।
এমনিতেও লোকটির মধ্যে স্ববিরোধ সীমাহীন। যে চ্যাপলিন সিনেমায় মানবতার শেষ কথা, তিনিই আবার হলিউডে কাস্টিং কাউচের প্রবর্তক শুনতে পাই। অনেক মেয়েকে লোভ দেখিয়ে ব্যবহার করেছেন। একজন বাবা এবং বর হিসেবে তিনি সার্থক হতে পারেননি। কেচ্ছার পর কেচ্ছা চ্যাপলিনকে তাড়া করেছে। তাঁর ইমেজের পাশাপাশি কেরিয়ারেরও ক্ষতি হয়েছে।
আর রাজনীতির থাবা?
চ্যাপলিন পেরোতে পারলেন না সেই প্রতাপকে যা তাঁকে সুযোগ দিয়েছিল তাকে শনাক্ত করার, তাকে উপহসিত করার, কিন্তু তাকে বিপন্ন করার সুযোগ সে দেবে কেন? দূর সম্পর্কের একজন কম্যুনিস্ট হতে বাধ্য ছিলেন চ্যাপলিন। ঠিক যেভাবে পাবলো পিকাসো বাধ্য ছিলেন, লুইস বুনুএল বাধ্য ছিলেন। ওটা রাজনীতির চেয়ে বেশি করে একজন মানবতাবাদী শিল্পীর বিবেকের ব্যাপার। কিন্তু এক ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্র সেই রোমান্টিকতা বরদাস্ত করবে কেন? আমেরিকা কখনই চাইতে পারত না তার সবচেয়ে জনপ্রিয় অভিনেতাটি তার সঙ্গে বেইমানি করবেন। এটা অবশ্যই ভেবে দেখা হল না, চার্লস চ্যাপলিন কোনো কম্যুনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য হতেই পারবেন না। তাঁর আবেগ ওই পন্থার জন্য নয়। কম্যুনিস্ট পার্টি আবেগ নয়, যান্ত্রিক আনুগত্য দাবি করে। চ্যাপলিনের জন্য পথটা আসলে সাম্যবাদের। ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’-এ স্বৈরাচারীর বদলে হাজির হয়ে যাওয়া ডুপ্লিকেট নাপিত চরিত্রটি যেমন বলে, ‘You the people have the power...then in the name of democracy, let us use that power, let us all unite! Let us fight for a new world, a decent world, that will give men a chance to work, that will give youth a future and old age security...Let us fight to free the world, to do away with national barriers, to do away with greed, with hate and intolerance! ’ এ কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের কথা নয়, এ একজন স্বপ্নদর্শীর কথা, ঊনবিংশ শতাব্দীকে লালন করা একজন মানুষ যিনি বিংশ শতাব্দীতে আছড়ে পড়েছেন, ব্যথা পাচ্ছেন। চার্লি রাজনীতির লোকই ছিলেন না, এবং... একই সঙ্গে, তিনি মোটেই অতি-দেশপ্রেমী ছিলেন না। মানুষের পৃথিবীতেই চার্লি শুরু এবং শেষ হয়ে যান।
আমার প্রিয়তম চ্যাপলিন-বায়োস্কোপ অবশ্য ‘মঁসিয়ে ভের্দু’ (১৯৪৭)। মানুষ যে আসলে এক পশু মাত্র, ১৯৪৭-এ সেটা সম্ভবত একটা প্রমাণিত ব্যাপার হয়ে গিয়েছিল। মানুষ শুধু টাকার কারণে মানুষের ফুসফুস ছিঁড়ে নিতে পারে, এটা আর অবিশ্বাস্য ছিল না একটুও। সেটা চার্লস ডিকেন্সের পৃথিবী নয়, লন্ডনের কোনো গ্যাস লাইট আর আলো দিতে পারত না তখন। কড়া ইলেকট্রিক বাল্ব সব মায়াকে নিঃশেষ করে দিয়েছিল। এই পরিসরে চার্লস চ্যাপলিন কী করতে পারতেন? ওটা তো তাঁর খেলা শেষের পরিসর! কিন্তু তিনি বিষে বিষ ঢেলে বিষক্ষয় ঘটালেন। পশুত্বের ধারণার মধ্যে খুঁজলেন মানুষের সেই দেবত্বকে যার জন্য কোনো বাইবেল লাগে না, গীতা লাগে না, কোরান লাগে না। দেখালেন অমৃতের মৃত্যু নেই। এই সিনেমা এই পৃথিবী একবারই পেয়েছে, আর পাবে না। একমাত্র চার্লস স্পেনসার চ্যাপলিনই তাকে এই সিনেমা দিতে পারতেন। দিয়েছেন। নিজের অসহায় সন্তান এবং প্রতিবন্ধী স্ত্রীকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য একটি লোক সেই মহিলাদের একের পর এক বিবাহ এবং খুন করছেন যারা প্রেমের পরোয়া করে না, বোঝে শুধু অর্থ, প্রতিপত্তি আর লালসার ভাষা। লোকটি কি পাপ করছে? মানুষ হত্যা এবং প্রাণী হত্যার মধ্যে ফারাক কোথায়?  সত্যিই কি বেঁচে থাকার মধ্যে আধ্যাত্মিকতার কোনো সুযোগ আর রাখা আছে? মানুষ কি মুর্গিতে পর্যবসিত নয় ক্ষুধার পৃথিবীতে, শেয়ার বাজারের ভুবনে? আর শাস্তি? এই লোকটিকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হল, কিন্তু... ‘One murder makes a villain. Millions a hero.’ এই উক্তির পরে সম্ভবত ঈশ্বরের আর কিছু বলার থাকে না। কারণ এই লোকটির সঙ্গে তাঁর কোনো ঝগড়া নেই, যা বিবাদ তা মানুষের সঙ্গেই, মানুষের হয়ে।
এই নাছোড়বান্দা প্রায় হাস্যকর মানবিকতার নিরিখেই গত ৫০ বছরে চার্লস চ্যাপলিন ততটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন না, যতটা তিনি আজ হয়ে উঠছেন। সেটা অবশ্যই সিনেমা নামক শিল্পটিতে তাঁর দক্ষতার জন্য নয়। অভিনেতা হিসেবে তিনি অতুলনীয়। কিন্তু অতুলনীয় অভিনেতা আরো অনেকেই আছেন। পরিচালক হিসেবে চ্যাপলিন কারিগরি ও নির্মাণের অনেক উপরে নিজের বার্তা এবং আবেগকে মান্যতা দিয়েছেন। নিজেকে বাদ দিয়ে নিজের সিনেমার একটা ফ্রেমকেও তিনি অনুমোদন করেননি। অধুনান্তিক পরিসরে এই আত্মমুখী মানসিকতা নিন্দিত হতে পারত, হয়েছে। কিন্তু এই পরিসরে আমাদের সামনে একটা নতুন আধুনিকের সম্ভাবনা জেগে উঠেছে। চ্যাপলিনের গুরুত্ব আজ তাঁর সৃষ্টি করে যাওয়া আবহাওয়ার জন্য। নিজের ব্যক্তিগত দুর্বলতাগুলোর সঙ্গে লড়াই করতে করতে এগিয়ে চলা একজন সম্পূর্ণ আধুনিক মানুষ ছিলেন এই লোকটি। আলো আর মানবজীবনের একীকরণের লক্ষ্যে তাঁর দৃষ্টিরেখা কখনই বিচলিত হয়নি। মানুষের রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে কলংকিত হিংস্র পরিসরটাতে দাঁড়িয়ে নিজের স্পন্দিত হৃদয়ে পুরোনো পৃথিবীর চিরকালীন মূল্যবোধগুলোকে জাগিয়ে রাখার এই ক্ষমতা... ঠিক এটাই আজ আমাদের শেখার আছে এই একমাত্র বিদূষকটির কাছে

2 comments:

  1. চার্লি চ্যাপলিন আমারো অত্যাধিক প্রিয় একটা চরিত্র এবং অভিনেতা। ওনাকে নিয়ে এত মূল্যবান একটা গদ্য পড়ার সুযোগ পেলাম , খুব ভাল্লাগছে

    ReplyDelete